Monday, August 17, 2020

স্বপ্ন বিলাস

     

    

    

      বিবাহ ব্যাপারটা বেশীর ভাগ মেয়ের মনেই যেন মুক্তির একটা মিষ্টি দখিনা হাওয়ার মতো বয়ে যায় মুক্তির দরজার চাবিকাঠি যেন কথাটার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে বিয়ে না হওয়া কুমারী মেয়ে তার প্রথম নতুন কেনা বেনারসী শাড়ির মতো সযত্নে তাকে কল্পনার বাক্সে তুলে রাখে, আর মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে ভাঁজে ভাঁজে হাত বুলিয়ে দেখে

    খোলা নীল আকাশে উধাও হয়ে যাওয়া বলাকা, ডুবন্ত সূর্যের শেষ বেলারকনে দেখামিষ্টি আলো, দূর থেকে ভেসে আসা গানের উদাস করা সুর, সব কিছু সৌন্দর্য্য তাকে এমন একজনের মুখ মনে পডিয়ে দেয়, যাকে সে কখনও চোখে দেখেনি শুধু কত রাত নিঃসঙ্গ কুমারী শয্যায় শুয়ে তার নিঃশব্দ পদধ্বনি শুনেছে সে আসছে, কতকাল ধরে সে শুধু আসছে যার হাতের মুঠোয় বাঁধা আছে একটি তরুণী মেয়ের মুক্তি মুক্তি নিত্য দারিদ্রের অভিযোগ থেকে, ছোট ভাই বোন গুলোর ঘ্যানঘ্যানানি থেকে, মায়ের ভিত্তিহীন অভিযোগ গুলোর গতানুগতিকতা থেকে আর তার একান্ত ব্যক্তিগত অতি সাধারণ একটি মেয়ের ভূমিকা থেকে

     তার কল্পনার রাজার রাজ্যে সে তো সামান্যা নারী নয় - সে যে রাণী! তার মুখের হাসি, তার ভ্রুকুটি সব কিছুর দাম অমূল্য সেই অসাধারণ পুরুষের আকুল হৃদয় থর থর কাঁপে তার করুণাকণার কিরণপাতে

     অনেক আনাগোনা, দরদাম, বেচাকেনার শেষে, এক অবসন্ন গোধূলীবেলায় সানাই বেজে ওঠে - রেকর্ডে কম্পিত চরণপাতে সাতপাকে বাঁধা তার বঁধূর দিকে পরম শুভ মুহূর্তে অনুরাগ  রঞ্জিত লজ্জাধীর নয়ন দুটি তুলে তাকায় সে - শুভদৃষ্টি

      এক পলকে ভারী একগোছা গোঁফ আর রাগী একজোড়া ভুরু ছাড়া বিশেষ কিছু চোখে পড়েনা তার পর আসে অগ্নি-দেবতাকে সাক্ষী রেখে গুরু গম্ভীর ভাষায় লম্বা চওড়া মন্ত্রোচ্চারণের পালা

     মধ্যবিত্ত - নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বিবাহ হয় সাধারণতঃ মধুচন্দ্রিকা ছাড়াই বাসর রাত্রেও কথা বলতে হল অনুচ্চস্বরে খুব সাবধানে - পাশের একমাত্র ঘরটিতে ছোট দুটি ভাই বোন আর বৃদ্ধ বাবা মা বর বয়সে বারো বছরের বড়, বললেন পারিবারিক দায়ীত্বের কথা, বাড়ির বড় বধূ হিসাবে তার কর্তব্যের কথা স্বামী হিসাবে নব বধূর সঙ্গে কিছু মিষ্টি মধুর হাস্যালাপ করা হয়তো তাঁরও কর্তব্য ছিলো, তবে কেন জানিনা, সে কথাটা তাঁর মনে পড়লোনা হায়রে স্বপ্নের বাসর রাত্রি - হায়রে স্বপ্নে দেখা মানুষ!

 

     বাসি বিয়ের পর দিন থেকেই আমাদের মেয়েটি পরিণত হল বাড়ির রাঁধুনি এবং শ্বশুর শাশুড়ীর nurse বাসন মাজার ঝি বাড়িতে লোক বাড়ায় দুদিন পরে বেশী মাইনে দাবী করে বসাতে, তাকেও ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা হচ্ছে

দুপুরে ঘন্টা দুয়েক তার অবসর ছোট দুটি দেওর ননদ স্কুলে শ্বশুর শাশুড়ী ঘরে নিদ্রাচ্ছন্ন ঘরে শাশুড়ীর পানের বাটার সামনে বসে সুপারী কুচোতে কুচোতে মেয়েটি ভাবে, এঁরা সবাই মানুষ খুব ভালো, অল্পদিনেই তাকে খুবই ভালোবেসেছেন বাড়িতে 'বৌমা', 'বৌদি' আরএই যে কোথায় গেলেসম্বোধনগুলো বেশ সস্নেহে উচ্চারণ করা হয় কিন্তু….

     কল্পনার জগতের সঙ্গে বড় অমিল যদিও দিনে স্বামীর ওপর তার কিছুটা টান জন্মেছে মানুষটা একটু রাগী, একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও অন্তর পরিষ্কার

     বছর ঘুরে আসে এক বছরে উল্লেখ যোগ্য ঘটনার মধ্যে ননদটির ক্লাসে উঠতে না পারা আর শ্বশুরের চোখের ছানি operation ছাড়া আর তেমন কিছু ঘটেনি বছর খানেক পর, কোথায় যেন ঘটে সুরের অভাবএই যে কোথায় গেলেডাকটি প্রয়োজন ছাড়া বড় একটা শোনা যায়না প্রতি সন্ধ্যায় কোন বন্ধুর বাড়ি বসে তাসের আসর - সেখানে যোগদান করা চাই

      সারাদিন অফিসের কাজ, সন্ধ্যে বেলা তাসের আসর - রাতে ঘুম আসে খুব তাড়াতাড়ি দিনান্তে দুটো কথা হয়না রান্নাঘর ধুয়ে মুছে, দরজায় তালা চাবি দিয়ে, আলো টালো গুলো নিভিয়ে মেয়েটি যতক্ষণে ঘরে আসে, তার জন্যে কেউ সে ঘরে অপেক্ষা করে নেই সশব্দ নাক ডাকা, অগোছালো বিছানার মধ্যে সাবধানে সে এক পাশে শুয়ে পড়ে - যাতে স্বামীর ঘুম না ভাঙে কোন কোন দিন তার অবস্থিতি অনুভব করে ঘুমে জড়ানো স্বরটি প্রশ্ন করে -

বাইরের দরজা বন্ধ আছে তো"?

     তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার শুরু হয় নাসিকা গর্জন পুরোন পাখার হাওয়া তেমন গায়ে লাগেনা পায়ের দিকে লুঙ্গি উঠে গেছে অনেক খানি, শোওয়াতে কেমন একটা অসহায় ভঙ্গি তাকালে কেমন যেন মায়া হয় কিন্তু সে তাকায় না তার জীবনের পুরুষটির দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে তো সে তাকাতে চায়নি বরং অনেক রাত অব্দি গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, মুক্তির দরজার চাবি কেন হাতে পেয়েও সে পেলোনা, কেন আরেক রকম বন্দীত্বে জড়িয়ে পড়লো? মা বাবা ভাই বোনকে ঘিরে সে জীবনও তো এর চেয়ে ভালো ছিলো অভাব ছিলো, একাকীত্ব ছিলোনা

      ঘরের পাশে এঁদো গলি খোলা জানলা দিয়ে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা গেলেও চাঁদের আলো পৌঁছয় না এই ঘরে শুয়ে স্বপ্ন দেখাটা বিলাসিতা ঠিকই, কিন্তু তাছাড়া আর বাঁচার উপায় বা কি!

      কলকাতা শহরে বছরে আট মাস গরমে মানুষ হাঁসফাঁস - ঘামে জামা কাপড় ভিজে, শীতের কটা দিন একটু সুখের শীতের আগে কোথা থেকে আসে এক ঝলক শিরশিরে হাওয়া, এঁদো গলির পাশে এক তলার ঘরেও সারা শরীরে সেই হাওয়া দেয় এক অজানা সুখের পরশ বুলিয়ে যে শরীরে এখন আসন্ন মাতৃত্বের চিহ্ন

      যমের দরজায় করাঘাত হেনেও মেয়েটি ফিরে আসে তার আপন জনের মাঝে, কোলে তার সুস্থ সুন্দর শিশু সন্তান সবাই শাঁখ বাজায়, আনন্দ করে

     নতুন শিশুর আগমন সবার গতানুগতিক বিরক্তিপূর্ণ জীবনে এক অনাস্বাদিত সাড়া জাগায় প্রায়ান্ধ শ্বশুর কাঁপা কাঁপা হাতে শিশুর কপালে হাত বুলিয়ে দেন - বলেনখোকা ভালো আছে তো? একেবারে কাঁদেনা তো আর শাশুড়ী তো খোকাকে কোলে নিয়ে হেসে কেঁদে অস্থির! ছোট দেওর ননদ দুটিরও আনন্দ রাখার স্থান নেই নতুন পিতৃত্বের গর্বে, মেয়েটির স্বামী তাসের আসর ছেড়েছেন সন্ধ্যেটা কাটে প্রায় খোকার পাশটিতেই

      শিশু বুকের দুধ খায়, হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে বড় বড় চোখে তাকায় মায়ের মুখের দিকে, তারপর হাসে, নিদন্ত হাসি

     কোথা থেকে ছুটে আসে সুখ স্বপ্নের ঘূর্ণি হাওয়া একটি ছোট্ট শিশুকে বুকে ধরে কি সুখ! মন তার উধাও ডানা মেলে দেয় আবার সীমাহীন কল্পনার আকাশে খোকাকে ঘিরেই আবার কত আশা আকাঙ্খা, কত কল্পনার জাল বোনা শুরু হয় অনুচ্চারিত স্বরে সে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করে - সার্থক আমি, সার্থক

 

২৩ - - ৮৭

সাসকাটুন

 


1 comment:

  1. very well written. In our country love and marriage is too much hyped, that is why there is so much disappointment. Glad that I never married, honestly!

    ReplyDelete

Please leave your comments