আয়নায়
মুখ দেখা
দশ
বছর হল এদেশে এসেছি। কিন্তু মশাই, আরাম কাকে বলে জানতাম না। মোটা মাইলের চাকরি, গাড়ি, মাঝারি সাইজের বাড়ি- সবই আছে। কিন্তু মনে
সুখ ছিলনা। Pizza আর burger খেয়ে খেয়ে
পেটে চড়া পড়ে গিয়েছিল। দেশী রান্না যে জানিনা তা নয়, ইচ্ছে
হলে করি, কিন্তু মশাই ঘরে spice এর
গন্ধ আর sink ভরা ডাঁই করা pots and pans, ওসব আমার পোষায় না। বান্ধবীদের সঙ্গে পূর্বরাগের পর্বে যদি কেউ খেতে চায়,
তবেই দেশী রান্না করি। ওই পর্বটা আমার অসহ্য লাগে - কোনরকমে চোখ কান
বুজিয়ে কাটানো। তবে বান্ধবী জুটিয়েছি কম নয়। গতবার Christmas এ gift পেয়েছিলাম সাতটা আর card পেয়েছিলাম সতের টা।
তবে ওই। মেয়েগুলোর খাঁই বড্ড
বেশী। Dinner এ নিয়ে যাও, dance এ নিয়ে
যাও – নানাভাবে তাদের মনোরঞ্জন করো। পয়সার শ্রাদ্ধ আরকি। কোন কিছু আর সস্তা নেই।
গত দশ বছরে আমার পরিবর্তনও কম হয়নি। সব থেকে প্রথম হল আমার নতুন নামকরণ,
সমীরণ থেকে Sam. টাই বাঁধতে জানতামনা - এখন
একটা perfect knot বাঁধতে কুড়ি সেকেন্ডও লাগেনা। নিজের
ভাষা বলতে গিয়েও দেখি দুদশটা ইংরিজী শব্দ এসে যায়। যাক ও নিয়ে মাথা ঘামাই না,
আমি এখন Sam চাউড্রি।
যাই হোক, বাড়ি পরিষ্কার, গাড়ি
পরিষ্কার, আরামে থাকার উপায় ছিলনা মশাই। দেশ থেকে মা সমানে লিখে চলেছে
প্যানপ্যানে চিঠি - “ওরে তুই কবে বিয়ে করবি। ওদেশী মেয়ে বিয়ে করলে কর,
নয়তো আমি মেয়ে দেখছি।” একদিন দুত্তোর বলে
রাজী হয়ে গেলাম। কাজটা ভালো করলাম কিনা - সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। পুরো
ব্যাপারটা ঘটতে মাসটাক সময় লাগলো। দেশে গিয়ে - এলাম, দেখলাম,
জয় করলাম। বিয়ে করে বউকে রেখে চলে এলাম। এইটুকুই আমার দায়ীত্ব। বাকি
সবই করলেন আমার শ্বশুর মশাই। মানসীর ভিসা পত্তর করানো, plane এর টিকিট কাটা, সব ওঁর দায়ীত্ব।
একদিন ফোন পেলাম, শনিবার সকালে মানসী এসে পৌঁছচ্ছে,
Airport এ যেতে হবে। একটা date
cancel করতে হল। Airport এ ওকে দেখে বুকের
মধ্যে একটা দারুণ উল্লাস অনুভব করলাম। পানপাতার মতো মুখ - বিষণ্ণ। ভীরু চোখের দৃষ্টি। শাড়ি সিঁদুরে
লটর পটর - ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছনো একটা মূর্তি। শনি, রবি দুদিন খুব দেখাশোনা করে ওকে চাঙ্গা করলাম। প্রচুর মিষ্টি মিষ্টি কথা
বানিয়ে বললাম। দেশী মেয়ের মন জয় করবার জন্যে dinner dance নয়,
একেবারে অন্য পথ।
সোমবার
থেকে সে আমার সম্পূর্ণ বশ। তার পর থেকে, well, I never looked back again. মশাই
কী বলবো - তোফা আরামে আছি। অফিস থেকে যখনই বাড়ি ফিরিনা কেন, দেখি টেবিল সাজিয়ে অপেক্ষা করছে, oven এ গরম খাবার।
আর সে খাবার - আঃ আপনাকে কী আর বলবো! সুক্তো, মুড়িঘন্ট,
এঁচড়ের ডালনা - যখন যেটা বলি। তবে ওই এক ফ্যাচাং - নিজে নিজে দোকান
বাজারটা করতে পারেনা। আমাকে নিয়ে যেতে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, গাড়ি
চালানোটা না হয় শিখিয়ে দিই। দোকান বাজারটাও ওই করুক। আবার ভাবি, বেশী স্বাধীন হয়ে যাবে না তো?
একদিন
গরম জলের ব্যাগ চাইলাম। ও ভয় পাওয়া চোখে তাকালো। বললাম,
driveway তে বরফ পরিষ্কার করতে গিয়ে পিঠে লেগে গেছে। তারপর থেকে,
আমার মতো পরিষ্কার driveway এ তল্লাটে আর কারো
নেই। মাঝে মাঝে gift wrap এ মুড়ে জুতো জামা কোট কিনে আনি-
যেগুলো হয়তো এমনিতেই কিনে দিতে হত। ও কিছু বলেনা (দেশী মেয়ে গুলো কি thanks
বলতেও জানেনা?) খালি কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়। বলি -
“Darling, বাবা মায়ের জন্যে মনকেমন করছে
নাতো? একটু টাকা জমলেই আমি আর তুমি দেশে বেড়িয়ে আসবো।”
মিষ্টি
কথা শুনে ওর দুচোখ জলে ভরে আসে। হোঃ হোঃ - কেন যে acting এ গেলাম না!
মুখের ভাব, গলার স্বরের পরিবর্তনে আমি perfection এ পৌঁছে গেছি। সিনেমায় নামলে উত্তমকুমারের পাশাপাশি আমার নামও লেখা থাকতো।
সেদিন
office
থেকে বেরোবার মুখে Clair এর সঙ্গে দেখা। বললো
-
“Sam honey, খবর পেয়েছি, দেশ থেকে তোমার বউ এসে গেছে। So what! I like married men! জানো তো, তারা বিয়ে করো বিয়ে করো বলে চাপ দেয়না।”
ঘন্টা
দুএকের জন্যে ওর apartment এ গেলাম। বাড়ি ফিরে দেখি, মানসীর শুকনো মুখ, চোখে ব্যাকুল দৃষ্টি। বুদ্ধি করে
বললাম -
“Very sorry darling! বরফে ঠান্ডায় গাড়ি
থেমে গিয়েছিল। প্রায় মাইল খানেক গাড়ি ঠেলতে হয়েছে - পা দুটো যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে
যাচ্ছে।”
নিষ্পাপ
মুখ করে মিথ্যে কথা বলা আমার ছোট বেলাকার অভ্যেস। আরে মশাই এটা survival
এর যুগ। এই survival কথাটাকে পতাকার মতো
উড়িয়ে, তার আড়ালে আমরা আমাদের যে কোন কুকাজ লুকাতে পারি।
সে যাক্, তারপর কী হল শুনুন - হোঃ হোঃ - সে কথা মনে পড়লে
হাসির চোটে আমার পেটের নাড়ি ভুঁড়ি ছেঁড়ার যোগাড় হয়। ও নীচু হয়ে বসে আমার জুতো
খুলতে লাগলো। হোঃ হোঃ স্নান করবার নামে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে খুব খানিকটা হেসে
নিলাম।
দিনে
service
ওর আর রাতে service আমার। মধ্যিখানের একটা
বিরাট gap সন্ধ্যেটুকু। মানসী কেমন যেন ভিজে ন্যাতার মতো
মেয়ে - বেশী কথাবার্তাও বলতে জানেনা। ওই সময়টা বেশ boring লাগে।
T.V. চলে, কাগজ পড়ি, মাঝে মাঝে office এর কাজের চাপ আছে বলে ঘন্টা দুয়েকের
জন্যে বেরিয়ে একটা bar এ গিয়ে বসি। দুচার জন পুরনো বন্ধু
বান্ধবীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। মানসী জেগে বসে থাকে। এই এক জ্বালা। আজকাল আবার
আমার অভিনয়ের মুখোশটা মাঝেমাঝে খসে পড়ছে, একটু সাবধান থাকতে
হবে।
একদিন
সে বললো, সারাদিন খুব ফাঁকা লাগে, সে university
তে কোন একটা class নিতে চায়। আমি কোন রকমে
“আচ্ছা খোঁজ নেবো খন” বলে কথাটা চাপা দিলাম।
ওরে বাবাঃ তার মানে লেখাপড়া করতে গেলে তো সে আর আমার service এ থাকবেনা, আর খরচের ব্যাপারটাও তো আছে।
সেদিন
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে একটা বিয়র নিতে kitchen এ গিয়ে দেখি, sink এ গোটা পাঁচ ছয় কাপ প্লেট। চমকে উঠলাম। কিছু জিগেস করার আগেই মানসী বললো -
“আজ দুপুরে চিত্রাদি এসেছিলেন, আরও দুতিন জন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে। উনি আমার কলেজের এক বন্ধুর দিদি। ফোন
করেই চলে এলেন। খুব হাসিখুশী মানুষ। খুব ভালো লাগলো আমার।”
এই
প্রথম আমি কিছুক্ষণ কথা খুঁজে পেলাম না। মানসীর এখানে কোন বন্ধু বান্ধব হোক, আমি একেবারেই তা চাইনা। রাগে ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। আচ্ছা নির্লজ্জ মহিলা
তো - বিনা নেমতন্নে একেবারে হুট করে চলে এলো?
এখানেই
শেষ নয়, দুদিন যেতে না যেতেই সন্ধ্যেবেলা ফোন। মানসী ও ঘরে
গিয়ে ফোনে কথা বলতে লাগলো। ওরে বাবাঃ - ঝাড়া পনের কুড়ি মিনিট ধরে কী হাসি গল্প।
এ মেয়ে এত কথা বলতে পারে?
ফোন রেখে এঘরে এসে বললো -
“চিত্রাদি ফোন করেছিলেন। অনেক করে একদিন
ওঁদের বাড়ি যেতে বললেন। নিয়ে যাবে একদিন?”
মুখে শুকনো হাসি জোর করে এনে বললাম -
“নিশ্চয়। কাজের চাপটা একটু কমুক।”
দেশী গুলোর সঙ্গে তো কোনদিন যোগাযোগও
রাখিনি। আমার কথা কে কতদূর কী জানে, কে জানে! মানসীর কাছে সব ফাঁস করে দিলেই
হয়েছে আর কী।
মানসী
আর কিছু বলেনা। ওর ওপর ক’দিন তীক্ষ্ণ নজর রাখি। হাবেভাবে কোন
পরিবর্তন হয় কিনা। কয়েক মাস গেলে নিশ্চিন্ত হই। না সব ঠিক আছে।
পুরনো
বান্ধবীদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের সঙ্গেই যোগাযোগ আছে। মানসী আর একা একা লাগছে বলে complain
করেনা - আমিও তাই অফিসের কাজে tour এর নাম করে
প্রায়ই এদিক ওদিক যাই। একবার তো পুরো একটা weekend লিজার flat
এই বন্দী ছিলাম, হাঃ হাঃ, একই শহরে। This is heaven!
এই
একটা বছর মানসী খুব ভালো service দিয়েছে। Reward হিসেবে ওকে একটা credit card করে দিয়েছি। প্রথম
প্রথম ওর খরচের দিকে নজর রাখতাম। নাঃ ভয় নেই। ওই ভিজে ন্যাতার মতো মেয়ে মাসে পঞ্চাশ/একশোর
বেশী খরচ করেনা। এ ব্যবস্থায় সে বেশ খুশী মনে হয়, সাজ পোষাকে
একটু পারিপাট্য, মুখে হাল্কা প্রসাধন, চেহারাটা
খুলেছে। তবে চুলে কাঁচি চালায়নি। ওর ওই লম্বা চুলের বেনীটা আমার অসহ্য লাগে। সে
যাক্ গে - একদিন ঠাট্টার ছলে বলে দিলেই হল, বোকাটা হয়তো
পরদিনই গিয়ে চুল কেটে আসবে।
এমনি
সুখে যায় যদি দিন যাক্ না। বাইরে খাওয়া দাওয়া ঘোরা ফেরার খরচ কমে গিয়ে bank
account ও এখন বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু এভাবে দিন গেলোনা। আমার
পুরনো বান্ধবীদের একজন - Judy, একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেললো।
বছর পাঁচেক আগে এই মেয়েটি আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলো, এবং
আমাকে বিয়ে করবার জন্যে বহু সাধ্যসাধনা করেছিলো। ওর প্রতি যে আমার দূর্বলতা ছিলোনা
তা নয়, কিন্তু মশাই আমার বিয়ের নামে আতঙ্ক। Judy যখন দেখলো আমি বিয়ের নামে নেই, শুধু ফুর্তির বেলায়
আছি, তখন দুম্ করে একটা মাথামোটা বনমানুষকে বিয়ে করে
ফেলেছিলো। তা সেই Judy একদিন সন্ধ্যেবেলা হাঁউমাঁউ করে
কাঁদতে কাঁদতে একটি ছোট ব্যাগ হাতে আমার বাড়িতে এসে হাজির। বরের সঙ্গে কোনদিনই
বনিবনা হয়নি। ঝগড়া ঝাঁটি লেগেই ছিলো, ইদানীং অবস্থা চরমে
উঠেছে। মারধোর শুরু হয়েছে। আজ ও কোনরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছে। আমার বাড়িতে
ক’দিন থেকে একজন উকিলের পরামর্শ নিয়ে বরটাকে ডিভোর্স করতে
চায়।
আমি
যেই আমতা আমতা করতে লাগলাম, Judy পাগলের মতো আমাদের পুরনো দিনের অনেক
ঘটনার দোহাই দিয়ে, আমার মনুষ্যত্বের কাছে আবেদন জানাতে
লাগলো। কী আর করি, basement টা ফাঁকাই, ওখানে ওর থাকার জায়গা করে দিলাম। টেলিফোন করে ওর জন্যে বাইরে থেকে খাবার
আনিয়ে দিলাম। শুধু তাই নয়, ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য সারা রাত
ওর কাছেই কাটালাম। Judy আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলো সর্বহারা
মানুষের মতো। পরদিন সকালে মানসীর মুখের দিকে তাকাতে পারিনি, তাই জানিনা
ওর চোখে মুখে কী ছিলো।
সারা
রাত আমার কাছে থাকবার পর Judy বিদায় নিলো; আমি
ওকে ওর মায়ের কাছে পৌঁছতে সাতশ মাইল পাড়ি দিলাম গাড়ি নিয়ে। ফেরার পথে সারাক্ষণ
ভেবেছি, কী ধরণের অভিনয় এখন প্রয়োজন মানসীকে এ’কদিনের কথা ভুলিয়ে দেবার জন্য। আমার নিষ্পাপ মুখ দেখে ও নিশ্চয় সব ভুলে
যাবে, after all আমি ওর স্বামী।
চাবি
খুলে বাড়ি ফিরে দেখি ও নেই। একটি ছোট চিঠি - মানসী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, পাশেই অন্য একটি শহরে আছে, ঠিকানা দেয়নি। হ্যাঁ,
আর আছে উকিলের একটি চিঠি, ডিভোর্সের কাগজ পত্র এবং আমার বাড়ি এবং
সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক অধিকারের দাবী।
মাথায়
আকাশ ভেঙে পড়লেও বোধহয় এতটা অবাক হতামনা। ভেবেছিলাম, প্রচন্ড রাগ হবে, কিন্তু হলনা। অন্ধকার living
room এ কিছুক্ষণ বসে থেকে আস্তে আস্তে bedroom এ গেলাম। দুচার খানা শাড়ি জামা ছাড়া বোধহয় আর কিছুই নেয়নি। বিয়েতে দেওয়া
আংটিটা ফেলে গেছে dressing table টার ওপর। এদিক ওদিক কিছু
কাগজ পত্র ছড়ানো। কিছু চাকরির দরখাস্ত। মানসী কিছুদিন ধরেই নানা শহরে চাকরির জন্য
application পাঠাচ্ছিল। জানতাম না। জানতাম না মানসীর Computer
Science এ Masters degree আছে। বিয়ের সময় শুনেছিলাম
বটে কী একটা Science এ কী একটা ডিগ্রি আছে, সেটা যে কী - জানার প্রয়োজন বোধ করিনি। ওকে তো
মানুষের মধ্যেই কোনদিন গণ্য করিনি।
সহসা
ঘরের আবছা অন্ধকারটা যেন ভারী একটা দানবের মতো বুকে চেপে বসলো। আমার শ্বাস বন্ধ
হয়ে আসতে লাগলো। একটা নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে উপলব্ধি করলাম, ওই ভিজে ন্যাতার মতো মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আমার জীবনের প্রথম
ভালোবাসা। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো, মানসী
তুমি শুধু আমাকে ক্ষমা করো। এই বাড়ি নাও, আমার যা কিছু আছে
সব নাও। যদি আমাকে সহ্য করতে না পারো আমার কাছে তোমায় আর কোনদিন ফিরেও আসতে হবেনা,
শুধু আমায় ক্ষমা কোর।

beautiful!
ReplyDeletebeautiful!
ReplyDelete