বিকেল চারটে বাজে। মীরা আর রাহুল স্কুল থেকে ফিরলো। এ সময়টা খুব ক্ষিদে পায় ওদের - এখুনি কিছু গরম খাবার ওদের খেতে দিতে হবে। নীতা রান্না ঘরে। আজ হচ্ছে চিকেন রোল, সব রেডি করা আছে। এখন নীতা শুধু রান্না করা চিকেনটা তাওয়ায় একটু গরম করে নিচ্ছে।
রাহুল ওর রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা নিয়ে একেবারে
নীতার পায়ের কাছে। ঘর ঘর আওয়াজ।
- বাবু, এখানে খেলোনা, দেখছো না আমি রান্না করছি!
- তুমি তো সবসময়ই রান্না করো। আর আমাকে বাবু বলে
ডাকবেনা, আমার নাম রাহুল।
গাড়ি নিয়ে মুখে হুঁই হুঁই ই আওয়াজ করতে করতে
রাহুল ফ্যামিলি রুমে চলে যায়। রাহুলের বয়স দশ। ওর কথাটা – 'তুমি
তো সবসময় রান্না করো', নীতার কানে বাজতে থাকে। ছেলেটা খুব একটা
মিথ্যে বলেনি। সকালে ব্রেকফাস্ট, বিকেলে স্ন্যাক্স, রাত্রে ডিনার ওরা
যতক্ষণ বাড়ি থাকে, নীতাকে তো শুধু রান্না করতেই দ্যাখে! মনোজ ফ্রিজে রাখা
বাসি খাবার খাবেনা - তার রোজ ফ্রেশ রান্না চাই। কাজেই এ বাড়িতে
রান্নার পাট টা একটু বেশীই।
স্কুল
থেকে ফিরেই, মীরা তার নিজের ঘরে চলে গেছে। সেখান থেকেই চিল
চীৎকার -
- কি মা তোমার হ’ল? আমার পেটে……
ওর চীৎকারে নীতার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। পরোটাগুলো চিকেনের
টুকরোয় রোল করতে করতে বলে-
- এইতো,
খাবার রেডি, সব হাত ধুয়ে চলে
এসো।
মীরার বয়েস চোদ্দ, এখানে এরা ওকে ডাকে মায়রা। ওদের বাবাও ডাকে মায়রা, আর ছেলে মেয়ের সঙ্গে কথাও বলে ইংরিজীতে। ওরা যখন খুব ছোট, ওদের বাংলা শেখানোর জন্যে নীতা ওদের বলতো যে ও ইংরিজী কথা বুঝতে পারেনা - তাই ছেলে মেয়ে বাংলায় কথা বলা শিখে গেল। নীতার সঙ্গে ওরা বাংলাতেই কথা বলে। এখন বড় হয়েছে, তাও ওদের ধারণা ওদের মা ইংরিজী জানেনা। ওদের আর কী দোষ।
বিয়ের পর পরই নীতা প্রেগনেন্ট, মাস্টারস্ ডিগ্রিটা
তাই আর শেষ করা হলোনা। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর কোলে এল মীরা। সে স্কুলে যাওয়ার
আগেই এল রাহুল। ওর সর্বস্য দিয়ে, অনেক যত্নে ও ছেলেমেয়েকে
বড় করছে। কিন্তু একটু বড়
হতে না হতেই ওরা কেমন যেন হাতের বাইরে চলে গেছে। ওরা যেন অন্য কোন
গ্রহের বাসিন্দা। অনেক চেষ্টা করেও নীতা ওদের চিন্তা ভাবনার নাগাল পায়না।
ওরা খেয়ে নিয়ে যে যার ঘরে চলে গেল, এখন হোম ওয়ার্ক করবে
বোধহয়। দুজনেই লেখাপড়ায়
ভালো। নিজেদের পড়া নিজেরাই
করে। তবে কিছু আটকে গেলে
ওরা বাবাকেই জিগেস করে, মাকে নয়। টেবিল থেকে ওদের ফেলে যাওয়া প্লেট গুলো তুলে সিংকে
রেখেই নীতা এবার ডিনারের ব্যপার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মনোজের বাড়ি ফিরতে
আটটা নটা বাজে। ফিরেই ডিনার রেডি চাই তার। নীতা একমনে কাজ করে
যায়। তবে মানুষের মনটাতো
কখনো চুপ করে থাকেনা, নানান ভাবনা ভেবেই চলে।
***
প্রেসিডেন্সি থেকে ম্যাথে অনার্স নিয়ে পাশ করে এম এস সি তে ভর্তি হয়েছিলো। বাবা মা ভালো পাত্র পেয়ে বড্ড তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা দিয়ে দিলো। ওদের দোষ কী? বিয়েতে নীপারও তো কম উৎসাহ ছিলোনা। সে তো অমত করেনি।
মনোজ
মেয়ে দেখতে এসেছিল ওর মা আর দাদা বৌদিকে নিয়ে। পছন্দ হবার পর একদিন
আলাদা কথা বলবে বলে ওকে ডিনারে নিয়ে গিয়েছিল। কিছুই লুকোয়নি। বলেছে এখন বিদেশে
ভালো ভাবে settle করলেও প্রথম দিকে কত struggle করতে হয়েছে। ওর বাবা নিজের জমানো
টাকা খরচ করে ওকে বিদেশে ম্যানেজমেন্ট পড়তে পাঠিয়েছিলেন। ওখানকার ডিগ্রি থাকার
ফলে চাকরি যোগাড় করতে তেমন অসুবিধে হয়নি। তবে বাদামী চামড়া বলে অন্যদের থেকে বেশী খেটে নিজের
যোগ্যতা প্রমান করতে হয়েছে। আরও বলেছিল, বিদেশে সব কাজ নিজেদের
করতে হয়। জিগেস করেছে নীতা
রান্না করতে জানে কিনা।
মনোজের ঝকঝকে স্মার্ট চেহারা আর নিঃশঙ্ক ব্যবহারে
নীতা তখন আপ্লুত। বিয়ে করে বিদেশে আসার জন্যে একপায়ে খাড়া। ওদেশে কত সুযোগ সুবিধে। এখানে অঙ্ক নিয়ে
মাষ্টার্স করলেও তো সেই ইস্কুলের চাকরি,
তার ওপর আবার বি এড লাগবে। তার পরেও চাকরি পাবে
কিনা সন্দেহ। হায়ার সেকেন্ডারির পর অতশত ভাবেনি। অঙ্ক ভালো লাগতো। রেজাল্ট খুব ভালো, অনেকগুলো লেটার। প্রেসিডেন্সিতে চান্স
পেয়েই ঢুকে পড়েছিল। ওই সময়টা যেন ওর জীবনের সব চেয়ে সুন্দর সময়। বন্ধু বান্ধব, কলেজ স্ট্রিটের বই
এর দোকানগুলোতে ঢুঁ মারা, দল বেঁধে সিনেমা নাটক দেখা আর মাঝে মাঝে কফি হাউসে
আড্ডা।
শীতের দিনে এখানে বড় তাড়াতাড়ি একটা মন খারাপ
করা অন্ধকার হয়ে আসে। স্টোভে ভাত বসিয়ে নীতা এক কাপ কফি নিয়ে বসে আর অনেক
কাল আগে ফেলে আসা সেই কফি হাউসের দিন গুলোর কথা ভাবে।
তবে নীতার এখানে খুব ভালো কয়েকজন বন্ধু আছে, কৌশিকি, মন্দিরা, স্বরূপা - আরও
দুএক জন। ওরা সবাই চাকরি করে, নীপার মতো বেকার
নয়। ওরা নীপাকে নানা
ব্যপারে উৎসাহ দেয়। গত বছরে পুজোয় জোরজার করে নাটকে ঢুকিয়েছিলো। প্রথমে না না করলেও, পরে নীতার বেশ ভালোই
লাগতো। রিহার্সালের পর খাওয়া
দাওয়া, গল্প গাছা। নাটক শেষ হ’ল, আড্ডাও শেষ।
মন্দিরার পরামর্শে নীতা online এ
একটা ওয়েব ডিজাইনের কোর্সও নিয়েছে। এখন নিচ্ছে java . একটা
কিছু পড়াশোনা করলে সময়টা ভালো কাটে। আর আছে
kindle এ download ক’রে বা লাইব্রেরি থেকে বই এনে - বই পড়া। এই বই পড়ার অভ্যেসটা নীতার বহুদিনের। যত ক্লান্তই হোক
না কেন, রোজ রাতে তার কিছুক্ষণ অন্তত বই পড়া চাই। মনোজের ঘুমের অসুবিধে
হবে বলে আগে বুক লাইট জ্বেলে পড়তো, আজকাল সে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্পটা
জ্বেলেই পড়ে। কারণ বেশ কয়েক বছর হ’ল মনোজ অন্য ঘরে
আলাদা ঘুমিয়ে থাকে।
***
ছেলেমেয়ের স্কুলে নীতা চেয়েছিল volunteer হিসেবে কাজ করতে। মনোজ সরু চোখে তাকিয়ে
বলেছিল
- কী করবে? ওদের রান্না শেখাবে?
- তা কেন,
গল্প টল্প পড়ে শোনাতে পারি।
- তা হলেই হয়েছে, তোমার ইংরিজীর যা
অবস্থা - তোমার উচ্চারণ কেউ বুঝতে পারলে হয়।
নীতার চোখ জ্বালা করে, মুখে কিছু বলেনা। না - ছেলে
মেয়েদের স্কুলে নয়, সে অন্য একটা স্কুলে যাবে। কারন, ছেলেমেয়েরাও চায়না
যে ওদের মা ওদের স্কুলে যায়। যখন
parent teacher meeting থাকে, সেখানে কথাবার্তা
মনোজই বলে, নীতা চুপচাপ বসে থাকে। Teacher ওকে
সরাসরি কোন কথা জিগেস করলে কিন্তু কিন্তু করে উত্তর দেয়।
মাঝে মাঝে সে স্নানের ঘরে গিয়ে ঝরঝর করে কাঁদে। ও তো এমন ছিলনা, কত প্রাণবন্ত হৈচৈ
করে ঘুরে বেড়ান মেয়ে ছিল। মা রাগারাগি করতেন, বলতেন - “তোর
কি ঘরে একেবারেই মন টেঁকেনা?”
এখন যেন ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বলে কোন বস্তুই নেই। তাই মনে আনন্দও নেই। যন্ত্রের মতো শুধু
সংসারের কাজকর্ম করে যায়। সপ্তাহে দুদিন একঘন্টা করে একটা ছোটদের স্কুলে যায়। বেশ লাগে। বাচ্চাগুলোকে গল্প
বলে, আঁকা শেখায়, সহজ করে অঙ্কও শেখায়। বাচ্চাগুলো ভালোবাসে
ওকে। তখন মনে হয়,
এইতো পড়াতে কত ভালো লাগছে, teaching profession টাই তো বেশ।
কথায় কথায় মনোজ প্রায়ই ওকে বলে -
- তোমার মাথায় কী আছে বলোতো? কী করে প্রেসিডেন্সি
কলেজে চান্স পেলে ভগবান জানেন।
মাঝে মাঝে ডাকে “গোবর গণেশ” বলে। সেটা নাকি তার আদরের
ডাক। প্রতিবাদ করলে বলে, নীতাকে নাকি ওই নামটাই ভালো মানায়। ছেলেমেয়ের সামনে
ওকে এভাবে ছোট করে মনোজ কী আনন্দ পায় তা সেই জানে। সে তো নিজের জন্যে
কিছু চায়নি। মনোজকে ভালোবেসে, তাকে সুখী করতে সেতো
তার সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল। কোথায় বেড়াতে যেতে ভালোলাগে, কী খেতে ভালোলাগে
সব ভুলে গেছে।
এখন তো শুধু বরকে আর ছেলে মেয়েকে খুশী
করে চলা। কিন্তু এত কিছুর
পরে যখন মনোজ ওকে বাচ্চাদের সামনে ঠাট্টা করার ছলে ছোট করে তখন অপমানে চোখ ফেটে জল
আসে। সব থেকে রাগ ধরে
নিজের ওপরেই, মনে হয় যেন নিজেকে বড় অল্প দামে বিকিয়ে দিয়েছে।
একবার দেশে বেড়াতে গিয়ে মাকে একা পেয়ে দুএকটা
মনের কথা বলতে গিয়েছিল। মা সবটা না শুনেই বিরাট এক মুখ ঝামটা -
- আমাকে আজ যা বললে বললে - খবরদার
যেন আর কোনও দিন এ ধরনের কথা তোমার মুখে না শুনি।
অমন সুন্দর বুদ্ধিমান স্বামী পেয়েছ, অনেক ভাগ্য তোমার! কী এমন যোগ্যতা আছে
তোমার শুনি?
নীতার
চোখ ফেটে জল আসে। মনে ভাবে যোগ্যতা দেখানোর আগেই তো বিয়ে দিয়ে দিলে।
***
পাশের ঘর থেকে বাবা আর মেয়ের মধ্যে উঁচু গলায়
তর্কাতর্কি চলছে। মেয়ের মাথায় calculus ঢুকছেনা। মনোজ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে হাল ছেড়ে দিলো। তারপর অনেক আলোচনার
পর ঠিক করলো, মেয়ের জন্য একজন private tutor এর ব্যবস্থা করা হবে।
সে রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নীতা মীরার অঙ্কের
বই উল্টে পাল্টে দেখলো। না তেমন ভুলে যায়নি। একটু ঝালিয়ে নিলে
সেই মীরাকে পড়া দেখিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মনে হয়না, মেয়ে ওর কাছে পড়া
বুঝবে।
পরের সপ্তাহ থেকে একটি অল্প বয়সী মেয়ে এসে মীরাকে calculus পড়াতে লাগলো। একটা বইও এনে দিয়েছে। Calculus for Dummies. এটা মীরার স্কুলের বই নয়, তাই এটা বাড়িতেই
থাকে, আর নির্জন দুপুরে TV না
দেখে নীতা ওটা পড়ে।
এক দুপুরে মন্দিরার ফোন -
- কীরে কী করছিলিস, ঘুমোচ্ছিলি না কি?
- হ্যাঁ তাইতো আমিতো সব সময় ঘুমোই, বেকার মানুষের আর কাজ কী?
মন্দিরা
বোঝে, ও না জেনে নীতার একটা ব্যাথার জায়গায় আঘাত করে ফেলেছে। সে অপ্রস্তুত হয়ে
বলে -
- নারে
seriously - কাজ করছিলি, disturb করলাম?
Lunch hour এ একটু সময় পেলাম, ভাবলাম তোর একটা
খবর নিই।
- না না ঠিক আছে। বল কেমন আছিস। আসলে আমি যা করছিলাম, শুনলে তুই হাসবি।
- বলে ফেল,
বলে ফেল।
- মীরার
calculus এর বইটা নেড়েচেড়ে
দেখছিলাম।
- আরে বাস্ রে, তুই কি মীরাকে calculus পড়াচ্ছিস না কি?
- আরে না
- সে আমার কাছে পড়বে না। তার জন্যে ঘন্টায় 50 ডলার
দিয়ে tutor রাখা হয়েছে।
- ঘন্টায় 50 ডলার? তা তুই tuition দিচ্ছিস না কেন?
- আমি যে সে কথা ভাবিনি তা নয়, কিন্তু কী বলতো? মনোজ অমনি বলবে, তোমার কী জিনিষটা
আটকাচ্ছে যে টিউশনি করতে হবে? তাছাড়া
student কে পড়াবার সময় তো সন্ধ্যেবেলা। সন্ধ্যেবেলা আমার
অসুবিধে।
ওপাশ থেকে
মন্দিরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে -
- তুই ভেবে দেখ, মনোজের সঙ্গে কথা
বল। দু তিনটে student তোকে
আমিই যোগাড় করে দেব।
- না রে,
আমি মনোজকে তো জানি - ও
কিছুতেই রাজী হবেনা।
আসলে নীতা বলতে চেয়েছিলো, মনোজ কিছুতেই allow করবেনা। কিন্তু সত্যি কথাটা
বলতে মানে লাগলো। মা একটা কথা প্রায়ই বলতেন - “আহাম্মকের
ছয়, ঘরের কথা পরকে কয়”।
দু
দিন পর আবার মন্দিরার ফোন।
- দেখ নীতা,
তুই সত্যি যদি কিছু করতে চাস, আমি কিন্তু তোকে
একটা idea দিতে পারি।
- বলনারে,
আমি সত্যিই একটা কিছু করতে চাই। এভাবে মনে হয় brain টা
দিনদিন dull হয়ে যাচ্ছে।
- কিছুই
dull হচ্ছেনা, তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী
মেয়ে। শোন, তুই একটা নিজের website তৈরী
কর। সেখান থেকে তুই calculus শেখাবি। online শেখাবি,
online payment নিবি। তার জন্যে তোর website এ e-commerce লাগবে। আমি তোকে
help করবো।
আরও বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা পর ঠিক হলো যে দুদিন পর
মন্দিরা আর কৌশিকি lunch time এ নীতার কাছে আসবে। একটা জবরদস্ত planning দরকার।
উত্তেজনায় নীতার রাত তিনটে অব্দি ঘুম এলোনা।এর পরের প্রায় মাস খানেক লাগলো, পুরো ব্যাপারটা চালু
হতে। Face book এ, Paypal এ account খোলা। Web site তৈরী করা। বন্ধুদের পরামর্শ অনুযায়ী নীতা একটা নিজস্ব bank account ও খুলে ফেললো। Paypal এ payment receive করতে হলে ওটা জরুরি।
***
Facebook
এ ওর বন্ধুরা জগত সংসারকে জানিয়ে দিলো
নীতার নতুন website
artofcalculus.com এর কথা। একটি দুটি করে ছাত্র
ছাত্রী আসতে লাগলো। One on one, on line teaching. একেবারে
calculus সমুদ্রে ঝাঁপ খাওয়ার
আগে আরও কিছু ম্যাথ এর background থাকা দরকার। সেটা যাদের নেই, তাদের base টা
সেই ভাবে তৈরী করে দিতে হবে। তাদের অন্য ভাবে পড়ানো দরকার। মুখে মুখে স্কুলের
ছাত্র ছাত্রীদের থেকে এখন কলেজের student দের কাছেও খবর পৌঁছে গেছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই
মনোজ বাড়ি ফেরার আগে অব্দি নীতা laptop নিয়ে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা ভাবে
ওদের মা কোন course নিচ্ছে।
একদিন দুপুর বেলা যে বন্ধুরা নীতাকে সাহায্য করেছিল, সেই চারজনকে ডেকে
ও একটা রেস্টুরেন্টে lunch খাওয়ালো। এই প্রথম একেবারে নিজস্ব রোজগারের টাকায় নীতা বিল
মেটালো। কী যে আনন্দ হচ্ছিল। অনেক অনেক দিন পর
এত আনন্দ। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ
চৈ করতে করতে মনে হলো যেন ও আবার সেই কলেজের দিনগুলোতে ফিরে গেছে।
এই এক বছরে Bank account
এ বেশ ভালো টাকা জমা পড়ছে। তার থেকেও বড় কথা
নীতা খুব আনন্দে আছে। ওর হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ও ফিরে পেয়েছে। আজকাল মনোজ ওকে গোবর
গণেশ বললেও ও কষ্ট পায়না, বরং মনে মনে হেসে বলে - জানোনা
তো!
***
তারপর এলো Covid. নীতার
ছাত্র সংখ্যা আরও বাড়লো। সে এখন
lecture record ক'রে, web এ
তুলে দেয়। আবার zoom ব্যবহার
করেও পড়ায়।
মনোজ কিছুদিন হ’ল বাড়ি থেকে কাজ
করছে। তবে ছেলে মেয়ের স্কুল
অবশ্য খোলা। এভাবে প্রায় দুমাস কেটে গেলো। একদিন দুপুরে নীতা lunch বানাচ্ছে, মনোজ এসে খুব গম্ভীর
স্বরে বললো -
- তোমার সঙ্গে কথা আছে।
নীতা একটু অবাকই হয়। মনোজ কোনরকম সাংসারিক
বিষয তো ওর সংঙ্গে আলোচনা করেনা। তাহলে কী
- ডিভোর্স দেবে না কী? বুকের মধ্যে একবার
যেন ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ও জানে ও মনোজের মন পায়নি, ও শুধু মনোজের house keeper. তারপর মন শক্ত করে নিজেকে বললো, আমিও সুখী নই, আমি আর ভয় পাবোনা।
মনোজ বলে -
- খাবারটা নিয়ে আমার সামনে এসে বসো।
নীতা মনোজের সামনে খাবারের প্লেট দুটো নিয়ে চুপচাপ
এসে বসে।
- আমার
department থেকে আমায় তিন মাসের notice দিয়েছে। এর মধ্যে অফিসেরই
অন্য কোন department এ আমায় কাজ খুঁজে নিতে হবে, না হলে টা টা বাই
বাই। আমার মনে হয়না সেটা
সম্ভব হবে, কারন
Covid এর জন্যে business এর অবস্থা খুব খারাপ।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে, নীতার গলা শুকিয়ে
ওঠে। কিন্তু একদিকে আবার
মনের মধ্যে কেমন একটা উল্লাস অনুভব করে। এই চাকরি নিয়ে মনোজের কত না অহঙ্কার! মাথা নীচু করে বলে -
- তাহলে এখন কী করবে ভাবছো?
- এই অফিসে অন্য কাজ পাবো বলে মনে হয় না। পেলেও দুদিন বাদে
সেটাও হয়তো চলে যাবে। আমি
H R এর সঙ্গে কথা বলেছি। নিয়ম অনুসারে আমাকে
ওরা ন মাসের মাইনে দেবে। আমি ভাবছি,
সেটাকে মূলধন করে আমি নিজেই একটা consultancy firm খুলবো। অনেক
client এর সঙ্গে আমার খুব ভালো relation আছে।
- সে তো ভালো কথা।
- আরে বোকার মরণ আর কাকে বলে! তুমি তো সংসারের কোন খবরই রাখোনা। বাড়ির mortgage, গাড়ির
payment, insurance, bills - তিন মাস পর এসবের
টাকা কোথা থেকে আসবে? আমার
business দাঁড় করাতে তো অন্তত
ছয় মাস তো লাগবেই। আমার তো কোন savings নেই!
- আমার আছে।
- কী আছে?
- Savings..
মনোজ
যেন আকাশ থেকে পড়ে! মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। কোন রকমে বলে -
- তোমার savings? কোথা থেকে? কত?
- ছয় মাস সংসার চালানোর মতো অন্তত আছে।
সব
কথা শুনে মনোজের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। গলার স্বর কাঁপছে। নীতার হাত দুটো ধরে
বলে -
- নীতা
please আমায় ক্ষমা করো। না জেনে আমি তোমায়
বোকা বলেছি, গোবর গণেশ বলেছি, সবার সামনে তোমায়
ছোট করেছি। মনে মনে ভাবতাম, তুমি আমার যোগ্য
নও। আসলে আমিই তোমার
যোগ্য নই। আমায় ক্ষমা করো।
এবার
নীতার কথা বলার পালা। সে বলে
-
- চেষ্টা করবো, তবে সময় লাগবে।
***
কিছুক্ষণ
পরে ছেলে মেয়ে কলবল করতে করতে বাড়ি ফিরলো।
- মা, শিগ্গিরি
snacks দাও। ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে।
মনোজ ওদের
সামনে গিয়ে কড়া গলায় বলে -
- মাকে এভাবে হুকুম করবেনা। ক্ষিদে পেয়েছে, যাও নিজেদের snacks নিজেরা
বানিয়ে নাও। যত্তসব…
ছেলে
মেয়ে দুটো হাঁ করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
***
