Friday, June 19, 2020

Rajasthan Stories (2) - অহঙ্কার




সোমনাথ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা ডাক্তার আত্মবিশ্বাসে ভরপুর চেহারাটা যেমন লম্বা চওড়া - তেমনি বুক ভরা সাহস কলেজে পড়বার শেষ বছরেই সোমনাথের পিতৃবিয়োগ ঘটলো মা গেছেন দু বছর আগেই মৃত্যুর আগে তিনি ছেলেকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর সইকমলএর মেয়েটিকে তাঁর বড় পছন্দ সই জানে সে কথা কোন কথা দেওয়া না থাকলেও, সোমনাথ যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েকমলএর মেয়েকে বিয়ে করে
মায়ের সই এর মেয়েকে সোমনাথ কয়েকবার দেখেছেন বেশ সুশ্রী চেহারা বি এ পাশ, পাড়ার একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায় কিন্তু বাবা হঠাৎ মারা যাওয়াতে বিয়ের চিন্তা বানের জলে ভেসে গেল বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে যাবার পর সোমনাথের জ্যাঠামশাই ওকে কাছে ডাকলেন, বললেন -
-         বাবা সোম, তোমার পরীক্ষার তো আর মাত্র ছয় মাস বাকি, সব পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে আমাকে বোলো, তোমার সংগে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে জরুরি কথা আছে
-         বিষয় সম্পত্তি? কি ব্যপার জ্যাঠামশাই?
-         না, তেমন কিছু নয় তুমি এখন মন দিয়ে লেখাপড়া করো, পরে কথা হবে
জ্যাঠামশাই বরাবরই রাসভারি মানুষ সোমনাথ আর কথা বাড়াননি  এরপর পরীক্ষার পড়ার চাপে তিনি জ্যাঠামশাই এর বিষয় সম্পত্তির কথা ভুলেই গেছিলেন
পরীক্ষা হয়ে যাবার দুদিন পর জ্যাঠামশাই আবার সোমনাথকে ডেকে সম্পত্তির কথা তুললেন ব্যাপারটা আর কিছু নয় - সোমের বাবা নাকি ওদের বাড়ীর অংশটুকু জ্যাঠামশাই এর কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিয়েছিলেন অতএব, এ বাড়িতে সোমের কোনও অধিকার নেই সে যেন অবিলম্বে অন্যত্র থাকবার ব্যবস্হা করে সোমনাথ অবাক হয়ে জানতে চান -
-         বাবা টাকা নিয়েছিলেন? কেন?
-         সে আলাদা বাড়ী করে ভিন্ন হতে চেয়েছিল
সোমনাথ একেবারে আকাশ থেকে পড়েন কোনরকমে  বলেন -
-         কিন্তু সে টাকা কোথায়? বাবার শ্রাদ্ধ বাবদ যা কিছু খরচ হয়েছে আর তো তেমন কোনও খরচা হয়নি পরীক্ষার ফিসের টাকা তুলতে গিয়েও দেখেছি, বাবার অ্যাকাউন্টে মাত্র হাজার চারেক টাকা পড়ে আছে
-         তা তো জানিনা আমার কাছ থেকে সে পন্চাশ হাজার টাকা নিয়েছিল তুমি যদি চাও তোমাকে আমি তোমার বাবার সই করা কাগজ দেখাতে পারি
-         এখন থাক জ্যাঠামশাই, আমি বরং একবার ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে দেখি, বাবার আর অন্য কোনও অ্যাকাউন্ট আছে কিনা

সোমনাথ স্নান খাওয়া না করেই দৌড়োলেন ব্যাংকে না কোথাও কিছু নেই কিছুতেই বিশ্বাস হয়না যে, তার বাবা জ্যাঠামশাই এর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন জ্যাঠামশাই তো খুব সাধারণ চাকরি করতেন, ধার দেওয়ার জন্য অত টাকা কোথায় পাবেন? ঠাকুরদাদার বানানো এই বাড়ীটাই ওদের সম্বল তাছাড়া জ্যাঠামশাই ওকে এ বাড়ি ছাড়তেই বা বলছেন কেন?

বিকেল বেলা কাউকে কিছু না বলে সোমনাথ গেলেন ওঁর জ্যাঠতুতো দিদি সুমনার শ্বশুর বাড়ী আপন দিদি না হলেও সুমনা সোমকে খুবই স্নেহ করেন হয়তো পুরোন কথা কিছু জানতেও পারেন
সব শুনে তো সুমনা অবাক গালে হাত দিয়ে বললেন -
-         বাবা তাহলে এই কাজ করেই ছাড়লো! কাকা টাকা নেবে কি, আমার বিয়ের সময় বাবাকে কাকাই বরং টাকা ধার দিয়েছিল বাবা শোধ দিতে পারবেনা জেনেও -  কাকা কোনদিন সে টাকা ফেরত চায়নি
-         দিদি আমি তাহলে কি করবো এখন? কাগজ পত্র দেখতে চাইবো?
-         তুই চাইতে পারিস, তবে মনে হয়না কোন লাভ হবে বাবাকে তো জানি হয়তো জাল দলিল তৈরী করেই রেখেছে
-         আচ্ছা দিদি, আমি চলি দেখি কি করি

রাত্রে ট্রামে করে বাড়ী ফিরতে ফিরতে সোমনাথ ভাবতে লাগলেন - বাবা হয়তো জ্যাঠামশাইকে ঠিকই চিনেছিলেন শেষ সময়ে রোগ শয্যায় শুয়ে ওকে বলতেন যত তাড়াতাড়ি পারে, সে যেন নিজের পায়ে দাঁড়ায়
রাতে সোমনাথ ঘুমোতে পারলেন না সকাল হতেই গেলেন মায়েরসইঅচলা মাসীর বাড়ী অচলা মাসী পুজো করছিলেন, ওঁর মেয়ে কাজল ওকে বসিয়ে চা টোস্ট দিল মুখ দেখে বুঝেছিল বোধহয় সকাল থেকে সে কিছু খায়নি

সব কথা শুনে অচলা মাসী ভারী দু:খ পেলেন একটু ভেবে বললেন -
-         তোমাকে তো ওরা গায়ের জোরে ও বাড়ী থেকে বের করে দিতে পারবেনা যতদিন না তোমার রেজাল্ট বের হয় আর তুমি একটা চাকরি পাও, ততদিন তুমি ওখানেই থাকো আমার কাছে না হয় দু বেলা খাওয়া দাওয়া কোর
-         না মাসীমা, ওখানে থাকবো, রোজ দুবেলা এখানে আপনার কাছে খেতে আসবো, সেটা একেবারেই practical হবেনা রেজাল্ট বের হতেও দেরী আছে তাছাড়া ও বাড়িতে আমার আর এক মুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই
-         শোন সোম, মাথা গরম কোরনা রেজাল্ট না দেখে কলকাতায় কেউ তোমায় কাজ দেবেনা, কিন্তু আমার মাসতুতো দাদা থাকেন জয়পুরে উনিও ডাক্তার পশ্চিমে বাঙালী ডাক্তারের খুব কদর আমি চিঠি লিখে দেব, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে তুমি গিয়ে না হয় ওদের বাড়ীতেই উঠো
-         আমি কোন অধিকারে ওখানেআমার আপন জনেরাই
-         তুমি বলো তাহলে তুমি কি করতে চাও
-         আমি একটা কথা ভাবছিলাম আমার মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, আমার সংগে কাজলের বিয়ে হয় আমিও কাজলকে খুবই পছন্দ করি মাসীমা আপনি যদি এই রকম একটা চালচুলোহীন ছেলের সংগে আপনার মেয়ের
অচলা সোমনাথকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলেন -
-         তুমি শিক্ষিত ছেলে আজ না হয় কাল, নিজের পায়ে দাঁড়াবেই তোমাদের বিয়ে আমি দেব
এই সময় কাজল ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে উঠে চলে গেল অচলা বলেন -
-         আমি আর আমার  সইকমলএর খুবই ইচ্ছে ছিল তোমার সংগে কাজলের বিয়ে হয়, কিন্তু তোমার মা আমাদের ফাঁকি দিয়ে আগেভাগে চলে গেল তুমি ডাক্তার হতে চলেছ আর কাজল সাধারণ মেয়ে, তার ওপর মাথার ওপর ওর বাবা নেই - তাই ওসব পুরোন কথা মন থেকে বের করে দিয়েছিলাম আজ বাবা তুমি নিজে থেকে ….
-         কিন্তু মাসীমা কাজলের মতও তো একবার নেওয়া দরকার!
-         ওর মন যে আমি জানি সোম, দেখলেনা - কেমন মুখটা লাল করে উঠে চলে গেল!
সোমনাথের মনটা পালকের মত হাল্কা লাগছে এখন এখান থেকে কাজলকে নিয়ে অনেক দূর চলে যাবে আর কোনদিন যেন জ্যাঠামশাইদের মুখ দেখতে না হয়

                                           ********************************

             এর পরের কতকগুলি ঘটনা খুব দ্রুত ঘটে গেলো জয়পুর থেকে অচলা মাসীর দাদার চিঠি এসে গেছে সোমনাথকে তিনি যত শীঘ্র সম্ভব জয়পুরে চলে আসতে লিখেছেন - সে এসেই ওঁর নিজস্ব ক্লিনিকে যোগ দিতে পারে আপাতত কিছুদিন ওঁদের বাড়ীই থাকবে, তারপর আস্তে ধীরে বাড়ী দেখে নিলেই হবে খন
      
 খুব অনাড়ম্বর ভাবে সোমনাথ এবং কাজলের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল এ পক্ষ থেকে এসেছিল শুধু সোমনাথের জ্যাঠতুতো দিদি সুমনা আর তার স্বামী কাজলকে ওঁরা সোনার হার আর বেনারসী শাড়ী দিয়ে আশীর্বাদ করলেন
বিয়ের দুদিন পর, সোমনাথ অচলাকে প্রণাম করে বললে -
-         মাসীমা, আপনি আমার জন্য যা করলেন, তা আমি সারা জীবন মনে রাখবো এবার আমি        আর কাজল দুজনে জয়পুর রওনা হব আপনি কাজলের জিনিষপত্র গুছিয়ে দিন
কাজলকে সোমনাথ এত তাড়াতাড়ি নিয়ে যেতে চাইবে, অচলা হয়তো তা আশা করেননি, কিন্তু যখন দেখলেন এ ব্যাপারে কাজলও বিশেষ আগ্রহী, তখন মন সায় না দিলেও আর তেমন জোর করলেন না

 তিনদিন পর সোমনাথ কাজলকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসলেন প্রথমে দিল্লী তারপর ট্রেন পাল্টে জয়পুর টেলিগ্রাম করা আছে ষ্টেশনে লোক থাকবে খুব সম্ভবত কাজলের মামাতো ভাই সুজয় ওদের চার ভাইএর মধ্যে সুজয় সব থেকে ছোট; এ ছেলেটি কলকাতায় তার অচলা পিসিমার সংগে কিছুটা যোগাযোগ রাখে চিঠিপত্রে তার খুবই ইচ্ছে সে বি এ পরীক্ষার পর এম এ পড়তে কলকাতায় চলে আসে

                                   **********************

 ট্রেন ঠিক সময়ই প্ল্যাটফরমে ঢুকে পড়ল ওই তো সুজয়! কাজল কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে হাসি মুখে হাত নাড়তে লাগল কিন্তু একি! সুজয়কে এমন দেখাচ্ছ কেন? চোখ মুখ বসা, উস্কো খুস্কো চুল! আস্তে আস্তে সব খবর পাওয়া গেল সুজয়ের বাবা অর্থাৎ কাজলের মামার গতকালই ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে এখন হাসপাতালে - বাঁচার আশা প্রায় নেই বললেই চলে সুজয়ের বড় তিন দাদা এরই মধ্যে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে বাক্ বিতন্ডা শুরু করে দিয়েছে সোমনাথ ভাবলেন, হায়রে কপাল! তুমি যাও বঙ্গে তো তোমার কপাল যায় সঙ্গে।।

এতখানি ট্রেন জার্নির পর হা-ক্লান্ত দুজনে কাজলের মামার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলেন সেখানে সারা বাড়িতে শোকের ছায়া যেন ইন্দ্র পতন ঘটে গেছে তারই মধ্যে কাজলের মামীমা চোখের জল মুছতে মুছতেই ওদের থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন
সোমনাথ চিন্তা করতে লাগলেন, এই রকম পরিবেশে এখানে থাকার কোন মানে হয়না অথচ সঙ্গে এত টাকা নেই যে কোনও হোটেলে গিয়ে উঠবেন এই প্রথম নিজের ওপরেই নিজের অতিরিক্ত রকমের আত্মবিশ্বাসের জন্য রাগ হতে লাগল

বাড়ির সামনে বাগানে পায়চারি করছেন, এমন সময় মামীমার ছোট ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওকে কাছে ডাকলেন বললেন -
-         বাবা সোম, দিদির কাছে তো সবই শুনলাম এখানে এই তো অবস্থা তা তুমি এখন কি করবে কিছু ঠিক করেছ?
সোমনাথকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বললেন -
-          তুমি কি আবার কলকাতায় তোমার জ্যাঠামশাই এর কাছে বা শ্বশুর বাড়িতে ফিরে যাবার কথা ভাবছো?
সোমনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন -
-         না সে পথ আমার বন্ধ অচলা মাসীমা চাননি যে আমি এখনই কাজলকে নিয়ে আসি বলেছিলেন আমি যেন এদিকটা একটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর ধীরে সুস্থে কাজলকে নিয়ে আসি আমি নিজের ওপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জোরেই খানিকটা জেদ করেই ওকে সঙ্গে এনেছি এখন তো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে এখানে তো আমি আর কাউকেই চিনিনা
-         তোমার অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি বাবা এমনটি যে হবে কেই বা ভাবতে পেরেছিল! তবে আমি তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে পারি সবটা শোন, তারপর ভেবে বলো
সোমনাথ উৎসুক দৃষ্টিতে এই সহৃদয় প্রৌঢ মানুষটির দিকে চেয়ে রইলেন
-         আমি তো তেমন কিছু একটা বড় মানুষ নই জামাইবাবুই আমাকে পরিবার শুদ্ধ নিয়ে এসেছিলেন জয়পুরে আমাকে একটা কাপড়ের দোকান করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন আমি সামান্য মানুষ, বেশি লেখাপড়া শিখিনি, ওই কাপড়ের দোকান থেকেই যা রোজগার আমার দোকানে কিষণলাল কেডিয়া বলে এক মারোয়াডী আসে - বাঙালী শাড়ি কিনতে
এই সময় সোমনাথ একটু অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন এই প্রৌঢ় মানুষটির জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে কিন্তু উনি সেসব কিছু লক্ষ্য না করেই বলে চললেন -
-         ওই কেডিয়া তার বাবার নামে একটা দাতব্য হাসপাতাল খুলেছে কিন্তু সে এক অজ পাড়া গাঁয়ে সেখানে কোন পাশ করা ডাক্তার বেশী দিন টেঁকেনা তুমি কলকাতার ছেলে, সেখানে কী থাকতে পারবে?
সোমনাথের এখন যা মনের অবস্থা - সে জাহান্নমে যেতেও প্রস্তুত! কোন রকমে বললেন -
-         আপনি আমাকে শুধু জায়গাটার নাম বলে দিন, আর একটা চিঠি লিখে দিন
-         ঠিক আছে তাই হবে তুমি দুটো দিন আমার ওখানে থাকবে চলো, আমি দিদিকে বলে দেব খন তার পর লোক দিয়ে আমি তোমাদের ওই গ্রামে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দেব

সোমনাথ অবাক হয়ে এই মানুষটির দিকে চেয়ে থাকেন পৃথিবীতে আজও এমন লোকও আছে? সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের জন্যে এমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া?

                                          *******************

তাই হল পরিচয় পত্র হাতে নিয়ে আর কাজলকে সঙ্গে নিয়ে সোমনাথ আবার অজানার উদ্দেশ্যে বাসে চেপে বসলেন

গ্রামটির নাম মালসিসর এ কাহিনী প্রায় সত্তর বছর আগেকার তখন মালসিসর একটা নেহাত অজ পাড়া গাঁই ছিল বটে পাশের গ্রামটির নাম আলসিসর শোনা যায়, যে ঝুনঝুনুর এক বর্ধিষ্ণু রাজ পরিবার এখানে দুটি গ্রাম পত্তন করেছিলো, সেই পরিবারের দুটি মেয়ে আলসি আর মালসি - তাদের নামেই এ দুটি গ্রামের নাম
জয়পুর থেকে সেই বাসের যাত্রাও মনে রাখার মতো পাকা রাস্তা কোথায়? চার দিকে সমুদ্রের ঢেউ এর মতো শুধু ধু ধু করছে বালির পাহাড় তার ওপর দিয়ে বাস চলেছে মানুষ জন ছাড়াও বাসে কিছু মুর্গি আর গোটা দুয়েক ছাগলও চলেছে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে ওঠে, গা বমি বমি করে - অনেকটা নাগর দোলায় চড়ার মতো অনুভূতি

কাজল পরম নিশ্চিন্তে সোমনাথের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে ওর ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে সোমনাথের মনটা মায়ায় ভরে গেল তাঁর দুর্ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্য জড়িয়ে ফেলে এ মেয়েটির কপালে কি আছে কে জানে কাজল তো এক কথায় দ্বিধাহীন ভাবে তাঁর হাত ধরে অজানার উদ্দেশ্যে ভেসে চললো সোমনাথ মনে মনে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন, কাজলকে উনি খুব খুব ভালোবাসবেন সব রকম দুঃখ থেকে ওকে দুহাতে আগলে রাখবেন


                               **************************

পরদিন বেলা দুপুরে বাস এসে পৌঁছল মালসিসর গ্রামে যেমন গ্রাম, বাস  ষ্টেশনও তেমনই যাই হোক, নেই নেই করে মালপত্র কিছু কম নয় কাজলের নতুন সংসারে লাগবে বলে অচলা মাসীমা হাঁড়ি কড়া অনেক কিছুই বেঁধে ছেঁদে দিয়েছেন সোমনাথ একটা টাঙ্গা ডেকে, মালপত্র তুলে কাজলকে নিয়ে উঠে বসলেন টাঙ্গাওয়ালাকে বললেন কেডিয়াদের হাসপাতালে যেতে
টাঙ্গা ওয়ালার নাম শিউপরসাদ - সে দুচার কথায় জেনে গেল ইনি হলেন গিয়ে হাসপাতালের নতুন বাঙালী ডাক্তার সোমনাথের খুব খাতির বেড়ে গেলো কান এঁঠো করা হাসি হেসে সে বললো -
-         বাবুজি মাহরো নাম শিউপরসাদ  এঠে তো ও একই অসপতাল হ্যয় - পর কোই ডাগদর কোনি এক বিহারি কম্পাউনডর হ্যয় - ব্যস্ উ সুঁই লগাওয়ে অওর আঙ্গরেজী ঝাড়ে
কি একটা গালাগাল দিতে গিয়েও সামলে নিলো

এদের হিন্দিটা কেমন অন্যরকম, বুঝতে বেশ অসুবিধে হয় যাই হোক, মিনিট পনেরো পরে টাঙ্গা গাড়ি হাসপাতালে এসে পৌঁছলো ভাগ্য ভালো - কিষণলাল কেডিয়ার ভাই মোহনলাল কেডিয়া ওখানেই ছিলেন, হিসেব পত্র দেখছিলেন খুব চটপটে লোক ছোট্ট গ্রামের হাসপাতাল - কোন নিয়োগ পত্রের বালাই নেই, মুখে মুখে মাইনে পত্রের কথা এক মিনিটে হয়ে গেলো সোমনাথকে সস্ত্রীক দেখে বললেন -
-         ডাগদর সাব, আপ ইয়ে টাঙ্গা লেকর আপকা কোয়াটার চলে যাইয়ে ম্যয় আপকে লিয়ে খানা পানি সব ভেজ রহা হুঁ আপ কল্ সুবে অসপতাল আ যানা

তারপর শিউপরসাদের সঙ্গে মঙ্গল বলে এক কাজের লোক দিলেন কাছাকাছি একটা বাড়িতে ডাক্তারের থাকার জায়গা নীচের তলায় খিলান দেওয়া ঢাকা টানা বারান্দা তিন চার খানা ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি - আর ওপর তলায় ছাদ পেরিয়ে একটা ঘর, খাট বিছানা পাতা সেটাই শোবার ঘর আধঘন্টার মধ্যে কুয়ো থেকে জল তোলা, ঘর দোর পরিষ্কার করা সব হয়ে গেল মঙ্গলের সঙ্গে শিউপরসাদও কোমর বেঁধে কাজ করলো তারপর কেডিয়াদের বাড়ি থেকে খাবার এলো - আটার লুচি, কি একটা তরকারি, খানিকটা ঝাল আচার আর হালুয়া খিদের মুখে তাই মনে হলো অমৃত
এবার একটু বিশ্রাম দরকার সোমনাথ শিউপরসাদকে  টাকা দিতে গেলে সে কিছুতেই নেবেনা বলে  -
-         সাব ম্যয় আপকো নওকর হুঁ

রাত্রেও কেডিয়া দের বাড়ি থেকে খাবার এলো সোমনাথের অভ্যাস ঘন ঘন চা খাওয়া, তাই কাজল বুদ্ধি করে এক প্যাকেট চা পাতা এনেছিলো মঙ্গলকে টাকা দিয়ে বাজার করিয়ে আনালো বিয়ের মাত্র পাঁচ ছয় দিন পর থেকেই নতুন দেশে কাজলের গৃহিনীপনা শুরু হয়ে গেলো

পর দিন সকাল হতেই সোমনাথ হাসপাতালে চলে গেলেন মোটামুটি কাজ চালাবার মতো সব ব্যবস্থা আছে কম্পাউন্ডার ছেলেটি এল আরও এক ঘন্টা পরে তার নাম গঙ্গারাম হলেও সে বেশ চটপটে তার কাছে নানা খবরও পাওয়া গেল
এখানে আর একজন বাঙালী ডাক্তার আছে তবে এম বি বি এস পাশ করা ডাক্তার নয় এল এম এফ না কি নাম শ্যামসুন্দর মোদক খুব পসার হাসপাতালের বাঁধা মাইনেতে কাজ করতে চাননা রুগী এলে বলেন - ফেলো কড়ি মাখো তেল অবশ্য ওরকম না করে উপায় বা কি! ভদ্রলোকের সাত মেয়ের পর একটি ছেলে সাত সাতটা মেয়ে - ওদের বিয়ে দিতে হবে তো!
আর একটা খবর - এখানকার রাজস্থানী লোকেরা, ঝাড ফুঁক, ওঝা, মন্দিরের ফুল প্রসাদ এসবে যত বিশ্বাস করে, এলোপ্যাথি ওষুধে তত নয় তাহলেও সোমনাথ জয়পুর থেকে ওষুধ আনাবার লম্বা লিস্ট করে দিলেন

সোমনাথের প্রথম রোগীরা আসতে শুরু করলো কেডিয়াদের বাড়ি থেকেই নতুন, পুরোন যার যত রোগ সব নিয়ে তারা হাজির এভাবে তাঁর  সুনাম ছড়িয়ে পড়তে আরও রোগী আসা শুরু হলো দাতব্য চিকিৎসালয় - কাজেই বিনা পয়সায় ডাক্তার দেখানো সোমনাথ রুগী দেখেন আর গঙ্গারাম কম্পাউন্ডার কাগজ আঁটা শিশিতে মিক্সচার তৈরী করে দেয়

                                          ***************************

এদিকে শ্যামসুন্দর ডাক্তারের পসার আস্তে আস্তে কমতে শুরু করলো রাগে দুঃখে ভদ্রলোক অস্থির হয়ে নানা অকথা কুকথা রটনা শুরু করলেন তাতে খুব সুবিধে হলোনা বাঙালী বলে সোমনাথ একদিন শ্যামসুন্দরের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন উনি ব্যস্ত আছেন ভাব দেখিয়ে ভালো করে কথাও বললেন না
দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে সোমনাথ শুনতে পেলেন শ্যামসুন্দর উঁচু গলায় স্ত্রীকে বলছেন -
-         আরে সদ্য পাশ করা ছোকরা ডাক্তার - চিকিৎসার জানেটা কী ? আসল কথা হল এক্সপিরিয়েন্স, বুঝলেনা অভিজ্ঞতা! অমন ঢের ঢের

আরও অনেক কিছুই বলে চললেন - সোমনাথ দ্রুত পা চালিয়ে ততক্ষণে দূরে চলে যাওয়াতে আর শোনা গেলোনা বাড়ি এসে কাজলকে শুধু বললেন -
-         তুমি গেলে কেমন আপ্যায়ন পেতে জানিনা, তবে মনে হয় ওদের বাড়ি তোমায় নিয়ে না গিয়ে ভালোই করেছি
কাজল সোমনাথের মুখচোখের বিষন্ন ভাব দেখে আর কোন কথা বাড়ালেননা তাড়াতাড়ি খাবার গরম করতে চলে গেলেন
খেতে খেতে সোমনাথ কাজলকে বললেন -
-         জানো, নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তুমি বালিগঞ্জের কলেজে পড়াশোনা করা মেয়ে, স্কুলে পড়াতে -  আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে তোমার জীবনকে জড়িয়ে এ তোমায় আমি কোথায় নিয়ে এসে ফেললাম! আমি তাও সারাদিন হাসপাতালে কাটাই, তুমি যে একা একা এই বাড়িতে কি করে সময় কাটাও জানিনা সে কথা ভাবলে
কাজল তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বললেন -
-         আমার কোন অসুবিধে হচ্ছেনা হ্যাঁ, এখানকার জীবন যাত্রা অন্যরকম বটে, তবে প্রতিদিন একটা নতুন অ্যাডভেনচার দেখ আজ পায়েস বানিয়েছি, এখানকার দুধ এত খাঁটি আর ঘন খেয়ে দেখো
-         কাজল তুমি এত রান্না বান্না শিখলে কখন?
-         ওই আরকি, মাকে দেখে দেখে একটু আধটু এবার বলো, শ্যামসুন্দর ডাক্তারের কি খবর
-         ওঁর আর কি খবর মনে হয় আমি আসাতে ভদ্রলোক খুবই মুস্কিলে পড়েছেন - বড় সংসার তো
-         তা ঠিক, তবে ওঁর নিশ্চয় বাঁধা রোগী পত্র আছে, private এ রোগী দেখেন তাছাড়া এতো সস্তা গন্ডার জায়গা
-         সেটা ঠিক আমি এখানে কি বা মাইনে পাই শুধু খাওয়ার খরচ ছাড়া আমাদের তো আর কোন খরচ নেই পরের মাস থেকে তোমার মাকেও কিছু কিছু টাকা পাঠিও আমি মানি অর্ডারের ফর্ম আনিয়ে দেব খন
কাজলের মনটা তার এই নতুন বিয়ে করা স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে ওঠে সত্যি, কতদিকেই না সোমনাথের নজর!

মঙ্গল তার বাড়ী থেকে তার বউ আর চারটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছে ওর পুরো পরিবার এখন কাজলের নির্দেশ পালন করতে ব্যস্ত থাকে মঙ্গল পরামর্শ দিয়েছে, পেছনের জমিতে গরু আর মুর্গি পুষতে দুধ আর ডিমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে কাজল একটু একটু করে ওদের ভাষা শিখছে শিউপরসাদ টাঙ্গাওয়ালা মাঝেমাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যায় বাস ষ্টেশনে কিছু দোকান আছে - সেখান থেকে বিস্কুট, চা, ডিম ইত্যাদি এনে দেয় কসাই বাড়ির বউ বোরখার নীচে লুকিয়ে পাঁঠার মাংস দিয়ে যায় এখানে মাছ পাওয়া যায়না বেশীর ভাগ লোকই গরীব আর নিরামিষাশী

                             *****************************

একদিন দুপুরে শ্যামসুন্দর ডাক্তারের স্ত্রী ছোট দুটি মেয়েকে নিয়ে কাজলের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন ওঁর নাম কল্যাণী ফ্যাকাশে শীর্ণ চেহারা, মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল, সারা শরীরে ক্লান্তির ছাপ তবে মানুষটা খুবই সরল মনে হয়, এতদিন পর বাংলায় কথা বলতে পেরে মনের আগল পুরো খুলে দিলেন কাজল ওঁদের ঘরে তৈরী নিমকি আর পায়েস খেতে দিলেন মেয়ে দুটি মঙ্গলের বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে খেলতে লাগলো একথা সেকথার পর কল্যাণী বললেন -
-         উনি বংশ রক্ষা বংশ রক্ষা করে করে পাগল সাত সাতটা মেয়ের পর ছেলে হওয়াতে এখন শান্তি
-         দিদি, ছেলের নাম কি ? কত বড় ?
ছেলের কথায় কল্যাণীর মুখচোখ উজ্বল হয়ে উঠলো বললেন -
-         ওর নাম তারক বাবা তারকেশ্বরের কাছে মানত করে ওই ছেলে এই সবে চারে পড়েছে
-         ওকে আনলেন না কেন দিদি, দেখতাম
-         না ভাই, উনি চাননা তারক বাইরে বের হয়, বলেন লোকের নজর লেগে যাবে তুমি কিছু মনে কোরনা ভাই সেদিন তোমার কর্তাকে তো
কাজল তাড়াতাড়ি কল্যাণীর হাত চেপে ধরে বলে -
-         ওসব কথা থাক না দিদি, এই যে আপনি আমার কাছে এসেছেন, তাতেই যে আমার কী আনন্দ হচ্ছে!
-         আমি কিন্তু ওঁকে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি বড় মেয়েদুটোর কাছে তারককে রেখে তবে আমারও মন পড়ে থাকে ছেলেটার কাছে খুব দুরন্ত কিনা - কথন কী হয়!

আর কিছুক্ষণ গল্প করে কল্যাণী আবার কখনও আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায়  নিলেন বিদেশ বিভুঁয়ে এই মাঝ বয়সী অকালবৃদ্ধা মহিলাটির জন্যে কাজলের মনটা মায়ায় ভরে গেল - ভাবলেন, মাঝে মাঝে কিছু জলখাবার তৈরী করে মঙ্গলের হাত দিয়ে ওদের বাড়ী পাঠিয়ে দেবেন

সোমনাথ বাড়ী ফিরলে পর সারা সন্ধ্যে কাজল শুধু কল্যাণীর গল্প করেই কাটালেন
-         জানো, কল্যাণীদি শ্যামসুন্দর বাবুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন - ভাবা যায়?
-         কেন ভাবা যায়না? তুমি যদি আমার মতো একটা
কাজল এবার হাত দিয়ে সোমনাথের মুখ চেপে ধরেন, বলেন -
-         আঃ শোনই না সবটা! কল্যাণীদির বাবা উত্তরপাড়ার খুব নাম করা উকিল বাড়ী গাড়ি সব আছে বাড়ীতে বিয়ের মত দেয়নি তাই কল্যাণীদি বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন বাবা পুলিশ লাগিয়েছিলেন
-         বাব্বা ! এযে দেখছি একেবারে সিনেমার গল্প ! তারপর ?
-         তারপর নানা জায়গায় ভেসে বেড়ানো - শ্যাম ডাক্তারের কোথাও বেশীদিন মন টেঁকেনা কোথাও তেমন পশার না জমলেই বলেন, এ জায়গাটা অপয়া - এখানে থাকবোনা
-         খুব অদ্ভুত লোক তো !
-         সত্যি কত রকমের লোকই যে আছে! বেচারা কল্যাণীদির জন্যে কষ্ট হয় নিজেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন - তাই ছেড়ে যেতেও পারেননি
লন্ঠনের আলোয় সোমনাথ দেখলেন কাজলের চোখে জল চিকচিক করছে একটানে কাজলকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলেন -
-         তুমি আমার ছেড়ে যাবেনা তো ?
কাজল কোন উত্তর দিতে পারেন না, কারণ ততক্ষণে সোমনাথ তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন

                                     ***********************************

দিন যায়
প্রতি সপ্তাহে কেডিয়াদের বাজার সরকার কি বাড়ীর কোন ছেলে জয়পুর, উদয়পুর কিম্বা দিল্লী যায় কাজল নিজের প্রয়োজন মতো কিছু সেলাই এর জিনিষ পত্র, পত্রিকা, উল কাঁটা ইত্যাদি আনিয়ে নিয়েছেন  ইচ্ছে - সোমনাথের জন্য একটা সোয়েটার বুনবেন শীতকালে এখানে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে
এ বছর হাড় কাঁপানো শীত পড়লো বটে দিনের বেলা রোদ উঠলে পরে ঠিকই আছে আসল ঠান্ডাটা পড়ে রাতের বেলা জলের বালতি বাইরে রেখে দিলে, জলের ওপর বরফের পাতলা একটা আস্তরণ পড়ে যায় রাতে ঘরের মধ্যে আগুনের আংটা জ্বেলে রাখতে হয় শুধু লেপে শীত ভাঙেনা

এমনই এক শীতের দিনে, শিউপরসাদ হাসপাতালে সোমনাথের সঙ্গে দেখা করতে এলো হাতের কাজ সেরে সোমনাথ শিউপরসাদকে জিগেস করেন -
-         ক্যয়া খবর শিউপরসাদ -  সব ঠিকঠাক চল্ রহা হ্যায় না?
-         খবর বুরি হোওয়ে ডাগদর সাব উয় শ্যাম ডাগদর কি লুগাই হ্যয় না, থারো সে দওয়া মঙ্গাওয়ে
-         কিঁউ ক্যায়া হুয়া?

জানা গেলো, শ্যাম ডাক্তারের ছেলেটির আজ সাতদিন হলো ধুম জ্বর তার ওপর বুকে সর্দি বসে গেছে তার বাবার ওষুধে কোনও কাজ হচ্ছেনা ওর মা আজ কাঁদতে কাঁদতে শিউপরসাদকে ডেকে বলেছেন সে যেন সোমনাথের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে আসে
সোমনাথ বললেন, রোগী না দেখে তো তিনি ওষুধ দিতে পারবেন না হাসপাতালের ডিউটি শেষ হলে উনি নিজে ওদের বাড়ী গিয়ে বাচ্চাটাকে দেখে আসবেন শিউপরসাদ বললো, যে সে ছটার সময় টাঙ্গা নিয়ে ডাক্তার বাবুকে নিতে আসবে সোমনাথ আন্দাজ করেছিলেন, এ নিশ্চয় নিউমোনিয়ার কেস - সেই বুঝে উনি ওঁর ব্যাগে ইনজেকশন আর অ্যান্টিবায়োটিক ভরে নিলেন

যথাসময়ে শ্যাম ডাক্তারের বাড়ী গিয়ে তারকের বুক পিঠ স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করলেন কল্যাণী আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জানালেন, কতদিন হয়ে গেল ছেলেটা বিছানায় পড়ে ওঁর স্বামীর ওষুধে কাজ হচ্ছেনা দেখে বাধ্য হয়েছেন সোমনাথকে খবর দিতে

সোমনাথ কল্যণীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন -
-         বৌদি আপনি তারককে কোলে নিয়ে বসুন, আমি একটা ইনজেকশন দেবো আর ট্যাবলেট সঙ্গে নিয়ে এসেছি, গুঁড়ো করে পাতলা দুধে গুলে দিনে তিনবার খাওয়াবেন
এই বলে সবে ব্যাগ থেকে ইনজেকশন বের করতে যাবেন, এমন সময় শ্যামসুন্দর বাইরে থেকে ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলেন এবং স্ত্রীর কোল থেকে তারককে ছিনিয়ে নিয়ে উন্মত্তের মতো চিৎকার করে সোমনাথকে একটা অকথ্য গালাগালি দিয়ে বলতে লাগলেন -
-         বেরিয়ে যাও - এখনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ী থেকে দুদিনের ছোকরা - নাক টিপলে দুধ বেরোয় - আমার বাড়ীতে ডাক্তারী ফলাতে এসেছো? বেরো এক্ষুনি - বেরো বলছি -
কল্যাণী ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন কোনও রকমে বললেন -
-         আমি - আমি ডেকেছি সোমনাথকে -
তার উত্তরে শ্যামসুন্দর কল্যাণীকে প্রায় মারতে গেলেন মেয়েগুলো ভয়ে মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো
সোমনাথ বললেন -
-         দেখুন, আপনি একটু শান্ত হোন তারকের বুকে সর্দি একেবারে বসে গেছে - বাজে রকমের ব্রন্কাইটিস্ ওর এখনই চিকিৎসা দরকার!
-         কি কি বলতে চাও তুমি, আমার ছেলের চিকিৎসা আমি করছিনা? আমার ছেলের ধাত তুমি আমার চেয়ে বেশী জানো? তোমার ওষুধে যদি আমার ছেলে মরে যায়?

সোমনাথ শুধু একবার কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন টাঙ্গা নিয়ে শিউপরসাদ দাঁড়িয়েই ছিলো সে শুধু বললো -
-         কে হোয়ো ডাগদর সাব, দওয়াই লিও কোনি?
-         নহি শিউপরসাদ, একলোতা বেটা হ্যায় না - উয় ডরতে হ্যাঁয়

সে রাতে দুঃখে, অপমানে, তারকের জন্যে দুশ্চিন্তায় সোমনাথ ঘুমোতে পারলেন না পরে খবর পেলেন, ওরা গত তিনদিন ধরে রানী সতীর মন্দির থেকে মন্ত্র পড়া জল এনে তারককে খাওয়াচ্ছে চারদিনের দিন, একটা মন খারাপ করা বিকেলের আলো আস্তে আস্তে নিভে যাওয়ার সময় তারক মারা গেলো

                                          ******************
                                                                                                    


No comments:

Post a Comment

Please leave your comments