Friday, June 19, 2020

Rajasthan Stories (1) সাথী





            স্বর্ণালীর বয়স মোটে ছয়। ডাক নাম সোনা। এই শীতের সকালে সে একটা নীল রঙের ঢাউস কোট গায়ে চাপিয়ে, দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ির গেটের সামনে দাঁডিয়ে বুধওয়া আর আনন্দির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। মা তো সকাল হতে না হতেই ঘুম থেকে তুলে মুখ ধুইয়ে পড়তে বসিয়ে দেয়। আর কে না জানে পড়তে বসলেই তার ঘন ঘন হাই ওঠে আর ঘুম পায়। তাই এদিক ওদিক দেখে সোনা এক দৌড়ে বাইরে চলে এসেছে। হাওয়াই চটি পরা, কাজেই পায়ে তার প্রচুর বালি। মা এই সময়টা ওদের বাংলা পড়তে বসিয়ে রান্না ঘরে জল খাবার বানাতে ব্যস্ত থাকে। দাদা সোম ওর থেকে প্রায় তিন বছরের বড়। মা তাকে বেশ কড়া শাসনে রাখে। তবে ছোট বলে সোনা যে পুরোপুরি পার পেয়ে যায়, তা নয়। মাঝে মধ্যেই কিল চড় জোটে বৈকি। আসলে রাজস্থানের এই অজ গাঁয়ে তেমন ভালো ইস্কুল নেই। অগত্যা বাড়ির কাছের পাঠশালাটাই ভরষা। পরের বছর অবশ্য সোম একটু দূরে বড় ছেলেদের ইস্কুলে যাবে। ওদের বাবা কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার। কোন্ ঘটনা চক্রে যে তিনি সপরিবারে এই নির্বান্ধব পাড়া গাঁয়ে ডেরা জমালেন, সে আরেক গল্প।
            ওদের বাড়িতে যে চাকরের কাজ করে, তার নাম সুন্দরিয়া। কুড়ি একুশ বছরের মুসকো জোয়ান, দেখতেও খুব সুন্দর। কিন্তু গেল মাসে বিয়ে করে এনেছে এক বোবা মেয়েকে। ওদের জাতে ছেলেদের টাকা পয়সা দিয়ে বৌ আনতে হয়। সুন্দরিয়া গরীব বলে ওর কপালে ওই বোবা বৌ জুটেছে। সঙ্গে এনেছে বৌএর ছোট ভাই - সাঁওরিয়াকে। 
এখন বেলা আটটা। সুন্দরিয়া বাইরে এসে সোনাকে ডেকে বলে -
  • এ সোন বাঈ, তন্নে মাজী বুলাওয়ে - জলদি আজা 
ওরা সব মেয়েদের নামের পরে একটা বাঈ জুড়ে দেয়। সোনা তার রুক্ষ উসকো খুসকো লাল চুল ঝাঁকিয়ে বলে-
  • তু যা রে 
  • জলদি আ, নঈতো মার পড়েগো।

            বন্ধুদের সামনে ব্যপারটা একটু অপমানজনক বৈকি, তবে সোনার বন্ধুরা এসব গায়ে মাখেনা। সব কটা তো মারের ওপরেই রয়েছে। ছোট মোট চড় চাপড় ওদের গা সওয়া। 
            সোনা মুখটা গোমড়া করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। বালি ভর্তি হলেও পাঁচিল ঘেরা অনেক খানি জমি সামনে। পাশের দিকেও কিছুটা জমি আছে, সেখানে স্নানের ঘর ইত্যাদি। আর আছে দুটো ছাগল, একপাল মুর্গী এবং একটা ভীষণ তাগড়া মোরগ। সোনার বাবা তার নাম দিয়েছে - মোটিয়ার।
            ওদের রোজকার জল খাবার হলো লুচি, আলু ভাজা, ঘরে পাতা দই, ওপরে একটু চিনি ছড়ানো। আর চা। শীতের দিনে মা ছোটদেরও চা খেতে দেয়। বাড়ি থেকে স্টেশন অনেক দূরে, সেখানে দোকানে পাঁউরুটি পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে সেখান থেকে রুটি বিস্কুট ইত্যাদি আনানো হয়।
            রান্না ঘরে মা মোড়ায় বসে লুচি ভাজছে, সুন্দরিয়ার বৌ লুচি বেলে দিচ্ছে। সে লুচি বেলতে জানতোনা। মা শিখিয়ে দিয়েছে। ওরা মোটা মোটা বাজরার আটার রুটি খায়।  সেই রুটি দুহাতের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরি করে আগুনে সেঁকে নেয়। তার পর সেটা খায় কাঁচা পেঁয়াজ আর ঝাল রসুনের আচার দিয়ে। 
            জলখাবারের পালা চুকলে বাবা কাজে বেরিয়ে যান। সোনা দেখে তার বাবার দীর্ঘ শরীরটার ধীরে ধীরে  হেঁটে যাওয়া। ওর বুকের মধ্যেটা টনটন করে। সারাটা দিন সে বাবাকে দেখতে পাবেনা। মনে হয় চীৎকার করে ডাকে - বাবা … বলে। কিন্তু বাবা পেছন থেকে ডাকতে বারণ করে দিয়েছেন। 
            এখন মায়ের কাছে বসে বাংলা আর ইংরিজী পড়বার সময়। ভাইবোনে বসে পড়ে আর একটু দূরে সাঁওরিয়া বসে হাঁ করে শোনে। ওর আগ্রহ দেখে মা ওকে স্লেট খড়ি কিনে দিয়েছে। সোনার পুরোন বই দিয়ে বলেছে - 

  • তুম্ সোনাকে পাশ পড়েগা - সারাদিন টো টো করকে নই ঘুরেগা, কেমন? 

            হি হি -নই ঘুরেগা" - মা এখানকার ভাষা একদম বলতে পারেনা। আগে বাবাও পারতোনা, তবে এখন অনেকটা পারে। নতুন এক একটা কথা শিখে এসে বাবা মাকে শেখায় আর দুজনে খুব হাসাহাসি করে। এত হাসির কি আছেরে বাবা। সোনা আর সোমের তো বাংলা ভাষাটাই হাসির মনে হয়! ওরা তো আর নিজেদের ঠিক বাঙালি বলে মনে করেনা। মা ভাত মেখে সোনার মুখে তুলে দিতে দিতে বলেগিলে ফেলো" - গিলা মানে তো ভিজে। পানি বা জলকে বাঙালিরা পিও বলেনা, বলে - খাও। জল খাও। সোনা আর সোম হাসাহাসি করলে মা রাগ করে, বলে, বাংলা ভাষার মতো এত মিষ্টি ভাষা নাকি সারা পৃথিবীতে কোথাও নেই। তা হবে বোধহয়। দু ভাই বোন বাবা মার কথা সব বুঝতে পারে তবে খুব ভালো বলতে পারেনা। 

            সোনা সাঁওরিয়াকে তার ছাত্র হিসাবে পেয়ে খুব খুশি কারণ ও তো যাকে বলে একেবারে আনপড্। অ আ ক খ থেকে শুরু। যদিও সে সোনার থেকে পাক্কা দুবছরের বড় এবং খুবই মনোযোগী ছাত্র তাও মাষ্টারি করতে গেলে মাঝেমাঝে কানমলা টলা দিতে হয় বৈকি। তার ফলে ছাত্রের পড়ার আগ্রহ থেকেও মাষ্টারনির পড়াবার উৎসাহ বেশী মনে হয়।  সোনা আর সোম যখন ইস্কুলে থাকে, তখন সাঁওরিয়া সোনার পুরোন ছেঁড়াখোঁড়া বই গুলো নিয়ে সারা দুপুর পড়ে।
মা বলে -
  • ছেলেটার মাথা আছে, ও অঙ্কটা আর একটু শিখে নিলেই ওকেও ইস্কুলে ভর্তি করে দেব। সোম যখন বড় ইস্কুলে যাবে পরের বছর, তখন সোনাকে একা একা ইস্কুল যেতে হবেনা - সাঁওরিয়া সঙ্গে যাবে।

            তাই হল। দুবছরের বড় হলেও, ছেলেটা সোনার ক্লাসেই ভর্তি হল। মা মরা ছেলে, দিদিটাও বোবা, এ বাড়িতে এসে কিছুটা আদর যত্ন পেয়ে সে যেন বর্তে গেল।

            সাঁওরিয়ার পড়ার আগ্রহ দেখে সোনাও লেখাপডায় মন দিয়েছে। ওকে অবশ্য আলাদা করে মার কাছে বাংলা পড়তে হয়। ওরা যখন হাত ধরাধরি করে ইস্কুলে যায়, তখন দেখতে বেশ মজা লাগে। সোনার গায়ের রঙ দুধে আলতা আর অন্য জন মিশমিশে কালো। 
            সুন্দরিয়ার বৌএর পর পর দু টো ছেলে হয়েছে - ওরা কেউ তাদের মায়ের মতো বোবা নয়, বেশ কথা বলতে পারে, আর ওদের মা হাঁউমাঁউ করে যা বলে, আর কেউ না বুঝলেও বাচ্চা দুটো বেশ বোঝে।

            ক্লাস ফোরে পরীক্ষা দিয়ে সোনা আর সাঁওরিয়া দুজনেই ওদের গ্রাম থেকে বৃত্তি পেল। বৃত্তির টাকা থেকে ছেলেটা বই কেনে আর অন্য গ্রামে ওর বাবাকে পাঠায়।  সোনার বইতে মলাট দেওয়া, স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে টিফিন বাক্স ভরে দেওয়া, সন্ধ্যে বেলা পড়তে বসার আগে, লন্ঠনের কাঁচ পরিষ্কার করা - এসবই সাঁওরিয়ার কাজ। এই কাজ গুলো সে পরম আনন্দের সঙ্গে করে থাকে। সাঁওরিয়ার হাতের কাজও চমৎকার। ফেলে দেওয়া জিনিষ, যেমন - খালি সুতোর ববিন, কাঠি এসব দিয়ে সোমের জন্যে গাড়ি, তার পর যে তে-ঠেঙে লম্বা লাঠিটা দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওর দিদি দুধ থেকে মাখন তোলে, তার নীচের অংশটার ওপর কাপড় জড়িয়ে চোখ মুখ এঁকে সোনার জন্যে পুতুল - এসব বানিয়ে সে সবাইকে চমৎকৃত করে দেয়।

            দিন যায়। সোনার বাবা এখন চাকরি ছেড়ে নিজেরদাবাখানাখুলেছেন। রুগী-পত্র নিয়ে আগের চেয়ে অনেক ব্যস্ত। বাড়িতে আর আগের মতো বেশী সময় দিতে পারেননা। সোম গেছে জয়পুরে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। আর মা তো খালি পড়তে বসো আর পড়তে বসো। এছাড়া যেন আর কোন কথা নেই।

            ধীরে ধীরে দুই অসম সমাজ স্তরের দুটো ছেলে মেয়ের বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। সোনার সব মনের কথা, আশা আকাঙ্ক্ষা - সব সাঁওরিয়াকে বলা চাই। বাড়ির পেছন দিকে কিছুটা জঙ্গুলে জমি নিয়ে একটা পোড়ো মন্দির আছে। তার ভাঙা পাঁচিলে দুজনে পা ঝুলিয়ে বসে আর যত মন প্রাণের কথা বলে। বেশীর ভাগ সময় অবশ্য সোনাই বক্তা এবং সাঁওরিয়া শ্রোতা। কোন সময় কোন দুষ্টুমি করেও মায়ের শাস্তির ভয়ে সোনা একাই এসে লুকিয়ে থেকেছে। পরে আবহাওয়া অনুকূল হলে সোম অথবা সাঁওরিয়া এসে ওকে ডেকে নিয়ে যায় 

            এবার সামনে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা - জয়পুরে গিয়ে দিতে হবে। সোনা আর সাঁওরিয়া দুজনেই খুব পড়াশোনা করছে। তারই মধ্যে সোনা একদিন পাশের ঘরে মা বাবার মধ্যেকার কথোপকথন শুনে ফেললো।

মা বলছে বাবাকে-
  • সোনার তো তোমার মতো ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে - জয়পুর, উদয়পুর কিম্বা দিল্লীতে যদি ভর্তি হতে পারে । 
  • আমারও ইচ্ছে সোনা ডাক্তারি পড়ে। কিন্তু সোমকে হস্টেলে রেখে পড়ানোতেই তো অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এক্স-রে মেসিন কিনেছি, মাসে মাসে তার কিস্তিও দিতে হচ্ছে।
  • দেখো, ছোট বেলা থেকে আমি সোনাকে কড়া শাসনে রেখে লেখাপড়া করিয়েছি। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভালো, ডাক্তার হতে চায়। ওকে আমি যেভাবে হোক গয়না বিক্রি করেও পড়াবো।
  • তোমার যা গয়না আছে, তা বিক্রি করলেও সামান্য টাকাই পাওয়া যাবে, তাতে করে সোনাকে হস্টেলে রেখে ডাক্তারি পড়াবার খরচ চালানো যাবেনা।
  • তা হলে উপায়? 
  • আচ্ছা কলকাতায় তোমার বাবার কাছে সোনা থাকতে পারবেনা?
  • না পারবেনা। আমি এ ব্যাপারে আগেই বাবাকে চিঠি দিয়েছিলাম। আমার বাবার বয়েস আশীর ওপরে, মাও বেঁচে নেই। বাবার পক্ষে সম্ভব নয় একটা ছোট মেয়ের দায়িত্ব নেওয়া।

খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর বাবা কথা শুরু করলেন -
  • জানো আরেকটা উপায় আছে। কি করে সেকথা তোমায় বলবো জানিনা। সেদিন আমার সঙ্গে প্রফেসর শর্মার কথা হচ্ছিল। তুমি তো জানো উনি সোনাকে কত স্নেহ করেন । উনি ওঁর ছোট ছেলের জন্যে সোনাকে চাইছিলেন। ছেলে জয়পুরে চাকরি করে। আমি বললাম, সেকি! সোনা তো এখন লেখাপড়া করছে। উনি বললেন সে তো বিয়ের পরেও পড়তে পারে। সব দায়িত্ব আমাদের।
  • ওরা পড়াবে সোনাকে?
  • তাই তো বললো। আসলে অল্প বয়সী ছেলে, তাকে উনি একা একা ফেলে রাখতে চাইছেন না। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে স্থিতু করে দিতে চান। তখন আমি প্রস্তাবটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এছাড়া তো আর কোন ঊপায় দেখতে পাচ্ছিনা। 

সোনার মাথা ঝিমঝিম করছিলো – সে আর কিচ্ছু শুনতে পারছিলোনা। এক দৌড়ে সাঁওরিয়ার ঘরের সামনে গিয়ে ওকে বললো -
  • অরে সাঁওরিয়া, মন্নে টুটা মন্দির যা রি হুঁ। - তু জলদি আজা।

            এই অন্ধকারে, সাপ খোপের মধ্যে! সোন বাঈ পাগল হল নাকি! সাঁওরিয়া তো পড়িমরি করে কোনরকমে একটা লন্ঠন নিয়ে দৌড়লো। সেই ভাঙা পাঁচিলটাতে পা ঝুলিয়ে সোনা বসে আছে। সাঁওরিয়া গিয়ে ওর পাশে বসতেই ওর কাঁধে মাথা রেখে সোনার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। সে কিছুতেই এখন বিয়ে করবেনা, আর বিয়ে না করলে ওর ডাক্তারিও পড়া হবেনা। 
            বিধাতার পরিহাস। ওই ভাঙ্গা মন্দিরে বসে ছিলো চার মাতাল। তারা দূর থেকে কান্নাকাটি শুনে ভাবল - প্রেমিক প্রেমিকা। এত নির্লজ্জ! এ গাঁয়ে এত বড় অনাচার করছে কারা? অন্ধকারে নির্জন জায়গায় এসে লীলা খেলা? সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। লাঠি আর থান ইঁটের আঘাতে সাঁওরিয়া তক্ষুনি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সোনাও লাঠির ঘায়ে একবার 'মাগো' বলে চীৎকার করে অচেতন হয়ে পড়ে গেল। এক মাতালের মনে তখন দুষ্প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে। সে সোনার শরীরটা উলটে ফেলে তার জামাকাপড় ধরে টানাটানি করতে লাগলো। আর ঠিক তখনি লন্ঠনের আলো সোনার মুখের ওপর পড়াতে, এক মাতাল চীৎকার করে ওঠে -
  • অরে বা রে -  ইয়ে তো ডাগদর সাব কি লড়কি হ্যায়।
  • অরে বাপ রে – ভাগ শালো -
চার মাতাল তখন লাঠি সোঁটা ফেলে দৌড়।
            এদিকে সাঁওরিয়াকে সোনার পেছন পেছন ওই ভাবে লন্ঠন নিয়ে দৌড়োতে দেখে সুন্দরিয়া সোনার বাবাকে ডেকে নিয়ে ভাঙা মন্দিরের কাছে পৌঁছল এবং সোনা আর সাঁওরিয়াকে ওই অবস্থায় আবিষ্কার করলো। সোনার আঘাত তেমন গুরুতর ছিলনা - সে দুদিন পর  সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো - কিন্তু ওর ছোট্ট বেলার সাথী, সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু সাঁওরিয়া আর ফিরলোনা।


No comments:

Post a Comment

Please leave your comments