Friday, June 19, 2020

Rajasthan Stories (3) বংশধর

             

        সেদিন সোমনাথের নেমন্তন্ন ছিল কেডিয়াদের বাড়ি। বড় কর্তা অর্থাৎ কিষনলাল কেডিয়া জয়পুর থেকে মালসিসরে নিজের পৈতৃক বাড়িতে এসেছেন। সোমনাথের সঙ্গে দেখা করতে চান। এরা বাঙালিদের মতো দেরী করে খায়না, রাতের খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। তাই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেই স্নান করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সোমনাথ কেডিয়াদের বাড়ি রওনা দিলেন। 
         পর্দা প্রথার প্রতি সম্মান বসতঃ কিনা বলা যায়না- সোমনাথের একারই নেমতন্ন, কাজলের নয়। তাতে কি, কাজলের সময় কোথা দিয়ে যে কেটে যায়। এখন মঙ্গলের বউ  সিমাকোরি  কাজলের কাছে বাংলা রান্না মোটামুটি শিখে নিচ্ছে। দুজনে মিলে নানারকম জলখাবার, আলুর  পরোটা,  নিরামিষ পোলাও, চপ ইত্যাদি বানায়।  তবে কাজলের সবথেকে যা প্রিয় খাবার - মাছ, তা এখানে পাওয়া  যায় না।  রোজ আমিষ বলতে মুর্গি বা খাসির মাংস
    সকালের চা জলখাবার সেরে আটটা নাগাদ  সোমনাথ কাজে বেরোন।  দুপুর দুটো নাগাদ বাড়ি এসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে মিনিট পনের বিশ্রাম নিয়ে আবার হাসপাতাল। তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরেন সেই ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ। এর মধ্যে আবশ্য দুবার মাঝরাতে ডাক পড়েছে - কোন এমারজেন্সী কেসের জন্য।
         সোমনাথ নিজেকে মনে মনে অপরাধী মনে করেন। বালীগঞ্জে বড় হওয়া একটি তরুণীকে এমন একটা নির্বান্ধব অজ পাড়াগাঁয়ে নিয়ে এসে ফেলার জন্যে। বাঙালী বলতে কেউ নেই। শ্যামসুন্দর ডাক্তারের পরিবার এক ছিলো - ছোট ছেলেটি মারা যাবার পর তারাও এখান থেকে কোথায় চলে গেছে। সোমনাথ তাই যতটা সম্ভব সঙ্গ দিয়ে, মজার মজার গল্প বলে, আদর করে কাজলকে ভরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। আর মজার মজার ঘটনা তো রোজই কিছু না কিছু ঘটছে। 
         এই তো যেমন সেদিন একজন লোক এলো। রুক্ষ, লম্বা চেহারা, মাথায় এক বিরাট পাগড়ী, কোলে বছর খানেকের একটি রুগ্ন শিশু। কুচকুচে কালো রঙ, হাড় জিরজিরে, নাকে চোখে নোংরা। শরীরের তুলনায় পেটটা বড়। 
সোমনাথ চোখ তুলে বলেন -
  • ক্যয়া হুয়া ?
উত্তরে লোকটি বলে -
  • ডাগদর সাব - ছোরোকো নজর লগ গয়ো -
কি আমার রাজকুমার রে - ছেলেটার অসুখ করেছে, বলে কিনা নজর লেগেছে।
  • ঠিক হ্যয়, বচ্চেকো য়ঁহা লেটাদো
    যথারীতি স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠ পরীক্ষা, পেট টিপে লিভার ইত্যাদি দেখা শুরু হলনিজের মনে বিড়বিড় করে বাংলায় বলেন - জহরলালের নাতির নজর লাগেনা আর তোর ছেলের নজর লাগছে!
জহরলাল নেহেরুর দুই নাতি রাজীব আর সঞ্জীব (তখন সঞ্জয় গান্ধীর নাম ছিল সঞ্জীব) এর ছবি খবরের কাগজে খুব ছাপা হত। মোটাসোটা ফর্সা টুকটুকে দুই ভাই।
         আর একদিন এক চাষী তার বউ আর তিনটি ছোট ছোট মেয়েকে নিয়ে এসে হাজির। হাত জোড় করে বলে-
  • ডাগদর সাব - মাহরো ঘর মাঁ ছোরো কোনি -
অর্থাৎ কি করে বউ পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে তার উপায় বলে দিন, নইলে যে বংশ রক্ষা হয়না
    আবার সেই জহরলাল! সোমনাথ নিজের মনে বিড়বিড় করেন - জহরলালের বংশ রইলোনা আর শালা  তোর বংশ !
সেই সব গল্প বাড়ি ফিরে মজা করে করে কাজলকে শোনান আর সে হেসে কুটিপাটি হয়।

        এদিকে সিমাকোরির ছেলে মেয়েরাও খুব মজার। পরমেশ্বরী, নানীবাঈ, বনোয়ারী আর সবচেয়ে ছোটটা লালচনিয়া।  নিজেদের মধ্যে যত ভাব তত মারামারি। পরমেশ্বরীর বয়েস পনেরো। ওর সগাঈ হয়ে গেছে দশ বছর বয়েসে। এখন সময় হয়েছে গাওনা করিয়ে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠানোর। ওর বর মিলিটারিতে - সেপাই। সেই গর্বে মঙ্গলের মাটিতে পা পড়েন। সে আবার অনেক টাকা নিয়ে পরমেশ্বরীর বিয়ে দিয়েছে। ওদের জাতে এটাই নিয়ম। মেয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ওদের রুটি পাকাবে, ক্ষেতে কাজ করবে, বাচ্চা কাচ্চার জন্ম দিয়ে বংশ রক্ষা করবে। তাই মেয়েদের ওরা খুব দামী অ্যাসেট মনে করে। 
         পরমেশ্বরী কথায় কথায় খিলখিল করে সারাক্ষণ হাসে আর নানীবাঈ কারণে অকারণে মুখ ভেটকে কাঁদে। তবে পরমেশ্বরীর যেমন উৎসাহ কাজলের কাছে সূচ সুতোর কাজ শেখার,  নানীবাঈ এর উৎসাহ বাঙালিদের মতো পাতলা করে রুটি পরোটা বানাতে শেখার।  এমনিতে ওরা বাজরার আটা দিয়ে মোটামোটা হাতে গড়া রুটি তৈরী করে কাঁচা পেঁয়াজ আর ঝাল আচার দিয়ে খায়। কখনো বা একটু ঘি মাখিয়ে তার ওপর চিনি ছডিয়ে খায়। ডাক্তার বাবুর বাড়িতে কাজ পাওয়ার পর ওদের খওয়া দাওয়ার কিছু উন্নতি হয়েছে - রুটির সঙ্গে সব্জি বা গরম কালে ছা, যেটাকে আমরা ঘোল বা বাটার মিল্ক বলি - সেসব জোটে। ওরা নিরামিষাশী, মাংস ডিম খায়না। দুধ বেশী থাকলে নয় ক্ষীর হয় আর নয়তো সিমাকোরি দুধের গামলায় একটা তে-ঠেঙ্গে লাঠি দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাখন তোলে - বাকি যেটা পড়ে থাকে সেটা ওই ঘোল। এই কাজটিকে ওদের ভাষায় বলে ঝগর বিলোনো।
সিমাকোরি কাজলকে খুব ভালোবাসে,  বলে -
  • মাজী আপ এঠেই রহ যাও, য়ঁহাসে কভি যানা মৎ ……
কাজলের ইচ্ছে করে দুপুর বেলা ওই ছেলেমেয়ে গুলোকে একটু লেখা পড়া শেখায় কিন্তু ও তো ওদের ভাষা জানেনা - কি করে পড়াবে!

        শীত চলে গিয়ে এখন প্রচন্ড গরম পড়েছে। দুপুর বেলা এমন একটা গরম হাওয়া দেয় - লু । বাইরে বেশীক্ষণ থাকলে লু লেগে লোক মরে যায়, যেটাকে আমরা বলি হিট স্ট্রোক হাসপাতালে আজকাল তাই লু লেগে যাওয়া রোগী খুব আসছে।
         সোমনাথের রেসাল্ট বেরিয়ে গেছে - ও খুব ভালোভাবে পাশ করেছে, এখন সে যে কোন বড় শহরে চাকরির সন্ধান করতে পারে। এ ব্যাপারে ও মাঝে মাঝে কাজলের সঙ্গে পরামর্শ করে। সোমনাথের ইচ্ছে এখানে কিছুদিন চাকরি করার পর ভালো রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজের একটা সেট আপ খুলবে। স্বাধীন ব্যবসা। পাশে থাকবে একটা ওষুধের দোকান। ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে দুজন বুঁদ হয়ে থাকে। 
         যাই হোক, যা বলছিলাম। সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সোমনাথ কেডিয়াদের বাড়ি পৌঁছে গেলেন। একটা বড় ঘরের মাটিতে বিরাট জায়গা জুড়ে ফরাস পাতা - সাদা চাদরে ঢাকা, মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাশবালিশের মতো তাকিয়া। সেখানে হেলান দিয়ে বসে কথাবার্তা শুরু হল কিষনলাল আর তার ছোট ভাই মোহনলাল কেডিয়ার সঙ্গে। বিরাট বাড়ি। মাঝখানে অনেক খানি জায়গা নিয়ে চৌকো উঠোন। চার পাশ ঘুরে অনেকগুলো ঘর। ঘরগুলোর সামনে টানা ঢাকা বারান্দা। দোতলায় ছাদের ওপর শুধু একটা ঘর - চার দিক খোলা। ভারী সুন্দর। সোমনাথ ভাবলেন, যদি কোনদিন নিজের বাড়ি করেন তাহলে ছাদের ওপর ওই রকম একটা হাওয়া মহল বানাবেন। গরম কালে সন্ধ্যার পর কেমন ঠান্ডা হাওয়া দেবে। 
        কেডিয়ারা বানিয়া - ব্যবসাদার, কলকাতায় যাদের আমরা মারোয়াড়ী বলি। এরাও রাজস্থানী, কিন্তু রাজস্থানের রাজপুতদের থেকে এদের চেহারা একেবারে আলাদা। রাজপুতদের দোহারা পাকানো চেহারা, মাথায় পাগড়ী, হাতে লম্বা লাঠি। মারোয়াড়ীদের শরীর মেদবহুল, রঙ বাদামী বা কালো। আর সবসময় কেবল ব্যবসা আর লাভ লোকসানের কথা। ব্যবসাই এদের ধ্যান জ্ঞান - তার বাইরে যেন কোন জগত নেই। তবে কিষনলাল কেডিয়া হয়তো বা একটু অন্য ধাতের মানুষ। জয়পুরে ব্যবসা করে যা আয় করেন তার একটা অংশ দিয়ে নিজের পরলোকগত বাবার নামে কেমন হাসপাতাল করেছেন। শোনা যায় তাঁর বাবা বেশ কম বয়সেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন, কারণ গ্রামে কোন হাসপাতাল বা ভালো ডাক্তার ছিলোনা। 
         কিছুক্ষণ গল্প গাছা করার পর রাত আটটা নাগাদ খাবার জন্যে ডাক পড়লো। বারান্দায় খাওয়ার ব্যবস্থা। মাটিতে পিঁড়ে পাতা।  সামনে একটু উঁচু একটা চৌকি - তার ওপর বড় বড় কাঁসার থালায় খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। থালার চারপাশে বেশ কয়েকটা বাটি সাজানো। কাচ্চরের সব্জি, আলুর ভাজি, সবুজ মুগের ডাল, বাড়িতে পাতা দই এর রায়তা, সেঁকা পাঁপড় আর গরম গরম রুটি। সেই সঙ্গে  ক্ষীর, রাজস্থানের বিখ্যাত প্যাঁড়া আরও কত কি! ওদের বৃদ্ধা মা একটা নীচু মোড়ায় বসে সোমনাথকে হাওয়া করতে লাগলেন। বাড়ির দুই বউ একগলা ঘোমটা টেনে পরিবেশন করলো। সব নিরামিষ খাবার 
         সামনে উঠোনে তিন চারটি ছেলে মেয়ে একটা ছোট্ট বছর দুয়েকের বাচ্চাকে নিয়ে খেলা করছে। ছোটদের বোধহয় আগেই খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। কি সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ। বড় বাচ্চাগুলির বয়েস আট থেকে বারো তের - তারা ছোট ভাই মোহনলালের সন্তান।  আর সবচেয়ে ছোট্ট বাচ্চাটি বড় ভাই কিষনলালের। বিয়ের অনেক বছর বাদে জন্মেছে। দেখতে খুব ফুটফুটে। এ বাড়িতে  সবাই শ্যাম বর্ণ, কিন্তু এই শিশুটি খুব ফর্সা, খুব মিষ্টি -  ভাই বোনেরা সবাই তাকে খুব আদর করছে। 
         সোমনাথ যখন বললেন - রান্না খুব ভালো হয়েছে, তখন কিষনলালজীর মা বললেন যে সব রান্না দুই বউ আর মহারাজ মিলে করেছে। এরা রান্নার লোক রাখে ব্রাহ্মণ আর তাকে সম্মান দিয়ে ডাকে মহারাজ বলে। 
        খাওয়া শেষ হলে মহারাজ এলো বড় বাটিতে করে হাত ধোওয়ার জল আর হাত মোছার ছোট গামছা নিয়ে। সে যখন জিগেস করলো, বাবুজী আমাদের রান্না আপনার ভালো লেগেছে, তখন উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সোমনাথ চমকে উঠলেন। ধপধপে ফর্সা রঙ আর মুখটা অবিকল ওই বাচ্চাটার মতো। 





No comments: