মহাভারতের কৃষ্ণ এবং “রণছোড়জী”
ছোট বেলায় বড়দের কাছে যখন
পুরাণের গল্প শুনতাম, তখন তা গল্প শুনতে ভাল লাগতো বলেই শুনতাম। তার সঙ্গে আমাদের
হিন্দু ধর্মের কি যোগাযোগ তা ভাববার বয়স হয়নি। বড় হয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়ে এবং অনেকের
সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম –
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের গল্প শুধু গল্প নয় – তা আমাদের ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।
আজ যা লিখতে
চলেছি তা সবই হয়তো আপনাদের জানা, তাও পুরনো কথা আমার মত করেই বলি। মহাভারতের
লেখক বলেছেন নর এবং নারায়ণ নামে দুজন ঋষি পরজন্মে অর্জুন এবং কৃষ্ণ হয়ে জন্মেছেন। এই নারায়ণ
ঋষি ছিলেন – বৈকুন্ঠবাসী নারায়ণ বিষ্ণু নন । মহাভারতে দুএকটি
জায়গা ছেড়ে দিলে কৃষ্ণকে পুরুষোত্তম পরমজ্ঞানী মানুষ বলেই মনে হয় । মহাভারতে
কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত নেই, তাঁর সাংঘাতিক কোন অলৌকিক ক্ষমতারও বর্ণনা নেই । তবে
নিজের সারাজীবনের উপলব্ধি ও দর্শনকে তিনি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে রেখে গেছেন-
তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি গীতায় । মানুষের মতো তিনি শোক দুঃখ পেয়েছেন, দেহত্যাগও করেছেন
সাধারণ মানুষের মতোই । উদাহরণ হিসাবে মহাভারত থেকে কৃষ্ণের জীবনের দুএকটি ঘটনা
উল্লেখ করা যাক ।
মহাভারতের কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে মথুরা
অধিকার করেন আবার সাধারন মানুষের মতো জরাসন্ধের ভয়ে (জরাসন্ধ একজন প্রবল
পরাক্রমশালী রাজা এবং সম্পর্কে কংসের শ্বশুর ছিলেন) মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় গিয়ে রাজত্ব
স্হাপনা করেন । পরবর্তী কালে তিনি ভীমের সাহায্যে
জরাসন্ধকে হত্যা করিয়ে পুরোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন ।
জরাসন্ধের ভয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যান যে মানুষ কৃষ্ণ তিনিও পূজিত হন দ্বারকায়
“রণছোড়জী”র মন্দিরে । আজকের লেখা সেই মানুষ কৃষ্ণ রণছোড়জীকে নিয়ে । তবে
তার জন্য একটু পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা যাক ।
দ্বাপর যুগে মথুরা ছিল রাজা উগ্রসেনের
অধিকারে । উগ্রসেন তাঁর দুই কন্যা রোহিনী ও দেবকীর বিবাহ দিয়েছিলেন বসুদেবের
সঙ্গে । কংস উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ পুত্র । দেবকীর বিবাহের সময় দৈববানী হয়েছিল যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের
সন্তান কংসের বিনাশের কারণ হবে । কংস তাঁর শ্বশুর মহাপরাক্রমশালী রাজা জরাসন্ধের সাহায্যে বসুদেব ও
দেবকীকে কারারূদ্ধ করে নিজে মথুরার সিংহাসনে বসেন । অলৌকিক
উপায়ে দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান বলরাম রোহিনীর কাছে পৌঁছে যান
(বলরাম অবশ্য রোহিনীর পুত্র বলেই পরিচিত) । দেবকীর অষ্টম
গর্ভের সন্তান কৃষ্ণকে বসুদেব গভীর দুর্যোগের রাত্রে গোকুলে নন্দের আশ্রয়ে পৌঁছে
দেন। কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য রোহিনীও বলরামকে নন্দের গৃহে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণ ও বলরাম দুই ভাই বড় হয়ে তাঁদের মামা
কংসের নৃশংসতার কথা জানতে পারলেন – কংসও জানতে পারলেন এঁদের কথা ।
কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করবার নানা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে কংস তাঁদের ধনুর্যজ্ঞে নিমন্ত্রণ
করে হত্যা করবার পরিকল্পনা করলেন । কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হল, কৃষ্ণর হাতে তিনি
নিজেই নিহত হলেন ।
কংসকে হত্যা করবার পর কৃষ্ণ মথুরার রাজা হলেন
। এদিকে জরাসন্ধ কৃষ্ণের বিরূদ্ধে তাঁর জামাতাকে হত্যা করবার অপরাধে প্রতিহিংসা
নেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন এবং বারবার মথুরা আক্রমণ করতে লাগলেন । আঠারো
বার ব্যর্থ হওয়ার পর জরাসন্ধ কালযবন নামে একজন মহাশক্তিশালী রাজার সাহায্য নিয়ে
মথুরা আক্রমণ করতে এগোলেন ।
এইখানে কালযবনের কথা একটু বলা দরকার । কালযবনের
পিতা গার্গ্য তপস্যা করে মহাদেবের কাছে বর পেয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র কালযবন অজেয়
হবে । কৃষ্ণ জানতেন সেকথা । তাই কৃষ্ণ যখন সংবাদ পেলেন যে জরাসন্ধ এবার আর একা নন,
কালযবন আসছেন তাঁর সঙ্গে মথুরা আক্রমণ করতে তখন তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে মথুরা ছেড়ে
দ্বারকায় চলে যাওয়াই সুবিবেচনা মনে করলেন । যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে শ্রীকৃষ্ণের নাম হোল রণছোড়জী ।
এখন কৃষ্ণ স্বয়ং মহাদেবের বরে অজেয় কালযবনকে কৌশলে কেমন করে বিনাশ করলেন সেকথা বলি । মান্ধাতার পুত্র মুচকুন্দ এক অদ্ভূত বর লাভ করেছিলেন । মুচকুন্দ নিদ্রিত থাকার কালে কেউ যদি তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করে, চোখ মেলে তিনি প্রথম যার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন সে অভাগা মুচকুন্দের চোখ থেকে নির্গত ক্রোধবহ্নিতে সঙ্গেসঙ্গে ভষ্মীভূত হবে । কৃষ্ণ সে খবরও রাখতেন । দেবাসুরের যুদ্ধে জয়লাভের পর শ্রান্তিতে অবসন্ন মুচকুন্দ একটি গুহার মধ্যে নিদ্রাবিভূত হলেন । কালযবনকে যুদ্ধে উত্তেজিত করে কৃষ্ণ মুচকুন্দ যে গুহায় ঘুমোচ্ছিলেন সেই গুহায় ঢুকে পড়ে মুচকুন্দের পিছন দিকে চুপিচুপি লুকিয়ে রইলেন । কালযবন হুঙ্কার দিয়ে সেই গুহায় প্রবেশ করলে মুচকুন্দ ঘুম ভেঙ্গে তাঁর দিকে প্রথম দৃষ্টিপাত করলেন এবং বলাই বাহুল্য কালযবন ভষ্মীভূত হলেন ।
এবার আসা যাক জরাসন্ধ-বিনাশের কথায় । জরাসন্ধ নরমেধ যজ্ঞে মহাদবের কাছে বলি দেবেন বলে অনেক ক্ষত্রীয় রাজাকে বন্দী করে রেখেছিলেন । মদগর্ব্বী অহঙ্কারী রাজা জরাসন্ধকে বিনাশ এই সব কারণে প্রয়োজন ছিল । সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করলে জরাসন্ধকে পরাস্ত করা সম্ভব নয় জেনে ভীম এবং অর্জুনকে নিয়ে কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে মগধে প্রবেশ করলেন । ভীমকে জরাসন্ধের শরীরে কোন জায়গায় দূর্বলতা আছে তা জানিয়ে দিলেন এবং ভীম সমুখ-সমরে জরাসন্ধকে হত্যা করলেন ।
শঙ্করাচার্য্য তাঁর দশাবতারে রাম এবং বলরামকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে স্বীকার করেছেন – কৃষ্ণকে নয় । অথচ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কৃষ্ণের নামে মন্দির এবং তীর্থক্ষেত্র রামের চেয়েও অনেক বেশী। কৃষ্ণকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে দেখি বহুপঠিত অন্যতম ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতে । হয়তো এরই প্রভাব হিসাবে কৃষ্ণকে বেশীরভাগ হিন্দুরাই বিষ্ণুর অবতার বলে মানে । কৃষ্ণের শিশু বা বালক রূপ, বালগোপাল রূপে – তাঁর যৌবনের রূপ, বংশীধারী রূপে, তারপর তাঁর বিষ্ণুরূপ- শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী নারায়ণ রূপে পূজিত হয় । বৃন্দাবনের মন্দিরগুলিতে কৃষ্ণ যেন মানুষ, তাই তাঁর মূর্তি দ্বিভুজ । আবার অনেক মন্দিরে কৃষ্ণের মূর্তি বৈকুণ্ঠবাসী বিষ্ণুর মতো চতুর্ভুজ । দ্বারকার রণছোড়জীর মন্দিরে কৃষ্ণের কালো কষ্টিপাথরে তৈরী মূর্তিটিও চতুর্ভুজ । তার মানে যদিও আমরা জানি যে আমাদের ভগবান কোন অলৌকিক ক্ষমতা না দেখিয়ে মানুষের মতোই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করেছিলেন তবু সেই ঘটনাকেও চিরস্মরণীয় করে রেখে আমরা তাঁকে রণছোড়জীর মন্দিরে বিষ্ণুরূপে চতুর্ভুজ মূর্তিতে পূজো করি ।
কৃষ্ণের প্রথম জীবন মথুরায় কাটলেও শেষ জীবন কেটেছে দ্বারকায় । দ্বারকা পবিত্র স্থান । এখানে গোমতী গঙ্গা সমুদ্রে এসে মিলিত হয়েছেন । গোমতীর তীরে দ্বারকার প্রাচীন শহরে আছে “রণছোড়জী” কৃষ্ণের বিখ্যাত মন্দিরটি । ছাপ্পান্নটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলে মন্দিরের স্বর্গদ্বার । শহরের দিকে মন্দিরের সিংহদ্বারের নাম মোক্ষদ্বার । এই মন্দিরের মত এত ভারী ভারী রূপার দরজা খুব কম মন্দিরেই আছে । মন্দিরের প্রাঙ্গনে কৃষ্ণের আত্মীয়বর্গের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধার মন্দিরও আছে । আর আছে মন্দিরের সংলগ্ন ক্ষেত্রে শঙ্করাচার্য্য স্থাপিত সারদা মঠ ।
রণছোড়জীর কথা বলতে রাণী মীরাবাঈ এর কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । রাজস্থানে কৃষ্ণপ্রেম প্রচার করেন মীরাবাঈ –তাঁর অপূর্ব মাধুর্যপূর্ণ ভজনের মাধ্যমে । মেবারের রাণী মীরা কেন মেবার পরিত্যাগ করে দ্বারকায় এসেছিলেন তা জানিনা তবে কিম্বদন্তী আছে যে এই মন্দিরেই তিনি বিগ্রহের মধ্যে বিলীন হয়ে যান যেখানে কেটেছিল তাঁর জীবনের শেষ কটি দিন । মীরাবাঈ মেবার পরিত্যাগ করবার পর মেবার রাজ্যে নানান দুর্লক্ষণ দেখা দিলে প্রজারা ভয় পেয়ে মনে ভাবলেন যে তাদের পরম ভক্তিমতী রাণী মীরা তাদের ছেড়ে চলে যাওয়াই এই সব দুর্ভোগের কারণ । তারা রাণার কাছে তাদের প্রিয় রাণীকে ফিরিয়ে আনার জন্যে দরবার করতে লাগলো । রাণা তখন কজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে পাঠালেন দ্বারকায় মীরাকে মেবারে ফিরিয়ে আনার জন্যে । মীরা ব্রাহ্মণদের বললেন যে তিনি ফিরে যাবেন তবে তার আগে তাঁকে রণছোড়জীর অনুমতি নিতে হবে । মন্দিরের ভিতরে ঢুকে তিনি দ্বার রূদ্ধ করলেন । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন মীরাবাঈ কোথাও নেই শুধু তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি লেগে আছে বিগ্রহের গায়ে । অপার অনুগ্রহে ভগবান নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন তাঁর পরম ভক্তকে ।
কৃষ্ণ অবতার কি না, তাঁর চতুর্ভুজ মূর্তি কেন হলো, মীরাবাঈএর কথা শুধু গল্পকথা কি না, এসব যুক্তি তর্ক মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসের কাছে হার মেনেছে ।
অনেক স্থানীয় লোকের
ধারণা যে দ্বারকার মন্দিরে যে বিগ্রহটি আছে সেটি আসল নয়। আদি রণছোড়জীর
মূর্তিটি আছে ডাকোরে। তবে সে আরেক কাহিনী। যদি আজকের এই লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগে
তবে আমাকে জানাবেন (suparnam@hotmail.com)
সে গল্পও আরেকদিন বলবো ।

No comments:
Post a Comment
Please leave your comments