কয়েক দিন ধরেই সিমাকোরির মধ্যে বেশ একটা চাপা খুশী খুশী ভাব। অমন যে গোমডামুখো নানীবাঈ, সেও যেন একটু ভালো মনে আছে।কৌতুহল চাপতে না পেরে কথায় কথায় কাজল একদিন সিমাকোরিকে জিগেসই করে ফেললো। তার একগাল হাসি।
-
অব বারিস্ আওএগো মাজী
-
তো ?
-
মাহরো তীজ কো তেওহার হ্যয় না।
-
উয় ক্যয়া হ্যয়?
সিমাকোরি অবাক হয়ে গালে হাত দেয়। ভাবখানা এমন যে এই পৃথিবীতে কি এমন কেউ আছে যে তীজের পরব কি তা জানে না? তারপর ভাবে, এরা বাঙালী - এদের সব পরব তেওহার নিশ্চয় আলাদা । তখন সে কাজলকে তীজের কথা খুলে বলতে থাকে।
রাজস্থান অন্চলে বৃষ্টি এক দুর্লভ বস্তু। বিধাতার এইরকমই বিচার। কোথাও ঝড় বৃষ্টি বন্যায় প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায়, আর এই মরুভূমির দেশে, শুধু ধু ধু করছে বালি আর বালি। রুক্ষ সুক্ষ প্রকৃতি আকাশের পানে অসীম তৃষ্ণা নিয়ে একটু জলের আশায় চেয়ে আছে।
শ্রাবণ মাস পড়ার আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় “তীজ” নামক তেওহারের। অবশ্য জয়পুর উদয়পুরের মতো বড় শহরে এলাহি ব্যপার, কিন্তু এই গন্ড গ্রামের লোকেরাও যথাসাধ্য মেতে ওঠে।
শ্রাবন মাসের তৃতীয়ায় শুরু - চলে হয়তো দুচার দিন ধরে। বেশীর ভাগ মানুষই এত গরীব যে তারা আবার চেয়ে থাকে, অবস্থাপন্ন গৃহস্থের মুখের দিকে। আসলে এই উৎসবটা হয় বিবাহিত মেয়েদের ঘিরে।
স্বামীর দীর্ঘায়ূ কামনায় নাকি?
না সিমাকোরি অত শত জানেনা, তবে তার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলবার ক্ষমতা দারুন। বলে, শিউজী মহারাজের প্রথম আওরত সতী মাঈ নিজের প্রাণ ত্যাগ দেওয়ার পরে উনি তো পাগলের মতো হয়ে গেলেন। সতী মাঈ একশ আট জন্ম পরে পার্বতী হয়ে পাহাড়ের রাজার ঘরে জন্মালেন। শিউজী মহারাজকে বিয়ে করার জন্যে জোর তপ শুরু করে দিলেন। অনেক দিন পরে শিউজী মহারাজ পার্বতীর দিকে চোখ খুলে দেখলেন আর তাকে বিয়ে করলেন।
এইসব গল্প পুরুষানুক্রমিক ভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হয়ে চলেছে মুখে মুখেই। বিবাহিতা মেয়েরা এইদিন সাজগোজ করে, উপোস করে থেকে পার্বতী মায়ের পুজো করে, তার পর মিষ্টি (ঘেওর, প্যাঁডা, লাড্ডু) খেয়ে উপবাস ভাঙে। যারা খুবই গরীব তারা হয়তো আটার হালুয়া বানিয়ে খায়।
এই গ্রামে একটাই মন্দির। সবচেয়ে বড় মূর্তিটি রাম সীতার, তবে হিন্দু ধর্মে যত জন দেব দেবী আছেন, মন্দিরে সবারই ছোট বড় মূর্তি আছে।
গেল বারে সোমনাথ যখন ওষুধ আনতে উদয় পুরে গেছিলেন, তখন কাজলের মামীমার সঙ্গে দেখা করে, মামীমার ভাইএর দোকান থেকে কাজলের জন্যে বাড়িতে পরার তিনচার খানা শাড়ি এনে দিয়েছিলেন। কাজল তার থেকে একটা বের করে সিমাকোরিকে দিতে গেল। কিন্তু সিমাকোরি তা কিছুতেই নেবেনা। শেষে বললো এত পাতলা শাড়ি দুদিনেই ছিঁডে যাবে, রঙ জ্বলে যাবে। তার চেয়ে মাজী যদি ওকে অল্প কিছু টাকা দেন তাহলে ও একটা ঘাগরা বানাতে দেয়।এখানে বেশীর ভাগ লোকই খুব গরীব, কিন্তু কাজল এখনও অব্দি কাউকে ভিক্ষে করতে দেখেনি, বখশিস দাও বলে ঝুলোঝুলি করতেও দেখেনি।অথচ দারিদ্রের অহঙ্কারও নেই।
খেটে খাওয়া মেয়েরা এক রকমের মোটা কালো কাপড়ের ঘাগরা পরে। তাতে কাঁচ বসানো কাজ। কালো রঙ কারণ নোংরা হলে বোঝা যাবেনা। আর যে দেশে জলের এত অভাব, সে দেশে কাচাকুচির বালাই তেমন নেই বললেই চলে।
এদের ছাতে ময়ূর আসে। কাজল দেখতে পেলে মুঠো ভর্তি গম নিয়ে ছডিয়ে দেয়। ময়ূর ময়ূরী খুঁটে খুঁটে খায়। বেশ লাগে দেখতে। এত সুন্দর পাখি। তবে তার বিরাট আকৃতির জন্যে পাখি না বলে প্রাণী বলাই ভালো। ময়ূর যেমন সুন্দর, ময়ূরী আবার তেমন নীরেস। ওরা খুব বেশী উঁচু উড়তে পারেনা। পেছনের জমি থেকে দোতলার ছাদ অব্দি। কিংবা এক গাছের ডাল থেকে আরেক গাছ অব্দি।
কাজল খাবার দেয় বলে না কি, কাজলকে এরা ভয় পায়না। একদিন একমুঠো গম হাতে নিয়ে কাজল ছাতের পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়েছিল, বড় ময়ূরটা কোথা থেকে ঝটপট আওয়াজ করে উড়ে এসে ওর হাত থেকে গম খেয়ে গেল। এর সমাপ্তিটা অবশ্য খুব প্রীতিজনক হলোনা। সিমাকোরির সবচেয়ে ছোট ছেলেটি, যার নাম লালচনিয়া, সে গুটিগুটি সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেই ছাদে ময়ূর দেখতে এসেছে- অমনি ময়ূরটা কর্কশ ক্যাঁ ক্যাঁ আওয়াজ করে এমন জোরে ছুটে ওকে তাড়া করে গেল যে, লালচনিয়া ভয়ে একেবারে ভ্যাঁ করে কেঁদে একদৌড়ে নীচে। এত সুন্দর পাখির এমন বিশ্রী গলার স্বর! আর কোকিল কালো বলে বুঝি সৃষ্টি কর্তা তাকে অমন মিঠে আওয়াজ দিয়েছেন!
একদিন ছাদ থেকে পেছনের জমিতে কাজল আর সোমনাথ, একটি ময়ূরীর মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্যে দুটো ময়ূরকে পেখম মেলে নাচতে দেখলো। সেদিন কাজলের কি আনন্দ!
সোমনাথ
বলে
-
-
দেখেছ কাজল, ময়ূরীটা কি অহঙ্কারী! দুটো বেচারা কৃপাপ্রার্থী কত খেটে মরছে, আর মহিলাটি ফিরেও দেখছেনা। নিজের মনে জমি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খেয়েই চলেছে।
-
কেন পাত্তা দেবে? ও
তো ভালোভাবেই জানে ওদের মতলবটা কি!
সে এক অপূর্ব দৃশ্য! আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, তার মধ্যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নেচে চলেছে। কাজলের গায়ে কাঁটা দেয়, কলকাতায় থাকলে কি সে কোনদিন এই শিহরণ অনুভব করতে পারতো? অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই একটা ময়ূর আরেকটা ময়ূরকে এমন তাড়া করে গেল যে অন্যটা চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে দৌড়। কাজল এই ছন্দপতনে যেন একটা মোহনিদ্রা থেকে জেগে উঠে বলল -
-
ইশ্!
-
ইশ্ আবার কি! ওর জায়গায় আমি হলে অন্য কাউকে ময়দানে ঢুকতেই দিতাম না। ওটা নেহাৎ ভালো মানুষ বলে rival টা কে এতক্ষণ বরদাস্ত করেছে।
-
আচ্ছা এবার নীচে চল, মেঘ ডাকছে, মনে হয় জোর বৃষ্টি আসছে।
-
চল, তবে ম্যাডাম, যত গর্জায় তত বর্ষায় না।
অবশেষে একদিন সেই বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি এলো রাতের দিকে। রাতে এমনিতেই একটু তাপমাত্রা কমে যায় - বৃষ্টি পড়াতে হাল্কা শীত করতে লাগলো। তবে মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো পরদিন দুপুর দুটো নাগাদ। বাড়ির ছাদের চারদিক দিয়ে নালা লাগানো আছে। ছাদ ধুয়ে তাই বাড়ির চারপাশের নালা দিয়ে কলের মতো ঝরঝর করে জল পড়তে লাগলো। সিমাকোরির ছোট ছেলে দুটো জামা কাপড় খুলে ফেলে দিয়ে উদোম হয়ে সেই জলের নীচে লাফালাফি করতে লাগলো।বৃষ্টি একটু কমে এলে বনোয়ারী এসে কাজলের কাছ থেকে একটা কাঁচের শিশি চেয়ে নিয়ে গেল।
বৃষ্টি থামতে দেখা গেল, সব জল বালিতে
শুষে
নিয়েছে।
কিন্তু
বালির
নীচে
একরকম
ভেলভেট
পোকা
থাকে।
ছোট
ছোট
Lady bug এর মতো দেখতে - শুধু ওপরটা যেন টুকটুকে লাল ভেলভেটে দিয়ে ঢাকা। জল পেয়ে তারা বালির ওপরে উঠে আসে। বনোয়ারী শিশিতে ভরে অনেকগুলো সেই ভেলভেট পোকা ধরে এনে কাজলকে দেখাতে এল। এরা মাকড়সা প্রজাতির হলে কি হবে, দেখতে চমৎকার! একটুও ভয় বা ঘেন্না করেনা। এই পোকাগুলোর নামও তীজ। তীজ পার্বণের সময় এরা বের হয়, তাই এই নাম, না এই পোকা গুলো বেরোনর সময় ওই উৎসব হয় বলে তাকে তীজ তেওহার বলে তা কে জানে!

1 comment:
A very interesting story
Post a Comment