কেয়ার টেকার
আমার নাতনি সুদীপ্তা – গতমাসে ১৭ য় পা দিয়েছে
এবং ক'মাস হল ইউনিভার্সিটি যেতে শুরু করেছে। যবে থেকে কলেজ শুরু করেছে, আমি ওর
মধ্যে একটা ভালো রকম পরিবর্তন লক্ষ করে চলেছি। বেশ একটা
ফুরফুরে ভাব – লেখাপড়া হোম ওয়ার্কের বালাই নেই। সাজগোজের
দিকেই নজর বেশী। কথাবার্তায়
বেশ একটা বড় বড় আর সবজান্তা ভাব। ওর মা, অর্থাৎ আমার পুত্রবধূ চাকরি করে – তাই বিকেল
বেলাটা ও ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গেই কাটায়। যাই হোক, ওর মনমেজাজ ভালো থাকলেই আমি খুশী।
সেদিন
দেখি, কলেজ থেকে ফিরেই দুমদাম্ ব্যাগ ট্যাগ এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলে
নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ ওকে একা থাকতে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে ওর বিছানায় গিয়ে
বসলাম। দেখলাম, চোখ দুটো ভিজে ভিজে লালচে, মুখটাও ফোলা ফোলা। বেশী কিছু জিগেস করতে
হলোনা – নিজে থেকেই বললো - শুভময়, অর্থাৎ যে ছেলেটিকে ও মনে মনে ভী – ষণ পছন্দ
করছিলো এবং মনে করছিলো যে এই বোধহয় ওর প্রথম এবং শেষ সত্যিকারের প্রেম, তাকে ও
পাবার আগেই হারিয়ে ফেলেছে। শুভময়ের বাবা ক্যানাডায় ইমিগ্রেশন পেয়ে গেছেন। আসলে
অনেক দিন ধরেই নাকি চেষ্টা করছিলেন। ওরা পরের মাসেই এখান থেকে চলে যাচ্ছে।
বলতে বলতে নাতনির চোখে আবার ঘন বর্ষা শুরু
হল। কী বলবো, ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আমার কোলে মুখ লুকিয়ে
ও বললো –
- "আচ্ছা দিদা, বলো তো – প্রথম প্রেম কি ভোলা
যায়?"
- "যায়, আবার যায়ও না।"
- "কেন একথা বলছো?"
- তাহলে তুমি মুখ টুখ ধুয়ে খাবার ঘরে এসো। জলখাবার খেতে
খেতে তোমায় একটা গল্প শোনাবো।"
গল্পের নামেই বোধহয়, কান্না ভুলে নাতনি খাবার
ঘরে এসে জলখাবার নিয়ে টেবিলে আমার সামনে এসে বসলো। আমি ওকে গল্প বলতে লাগলাম।
দেশ
তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে।
কিছু
কিছু লালমুখো সাহেব তখনও পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়তে পারেনি। আমাদের পরিবার সাহেব-ঘেঁষা না হলেও, বাবার বন্ধু বিজয় কাকু সাহেবদের সঙ্গে
ওঠাবসা খুবই পছন্দ করতেন।
শুনেছি, বাড়িতেও নাকি খাবার সময় টেবিল চেয়ারে বসে কাঁটা চামচ ব্যবহার করতেন। বিজয় কাকুর সম্পর্কে এত
কথা বলার কারণ আমার গল্পের সঙ্গে তাঁর বেশ কিছুটা যোগাযোগ আছে।
অল্প
বয়েস থেকেই আমি বেশ স্বাধীনচেতা আর জেদী মেয়ে ছিলাম। দেশশুদ্ধ লোক যখন বৃটিশ-রাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল – আমি তখন আর এক
রকম দাসত্বের কথা চিন্তা করছি।
আমি
মনে করতাম, বিয়ে করাটাও এক ধরণের পরাধীনতা এবং বিয়ে করা
মানে একজন পুরুষ মানুষের তাঁবে জীবন কাটানো। তাই ঠিক করেছিলাম যে আমি
কোনদিনও বিয়ে করবোনা।
পড়াশোনা
করে চাকরি করবো এবং চিরকুমারী থেকে জনকল্যাণের কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করবো। মা আমার ওপর মাঝে মাঝে চেঁচামেচি
করলেও আমার সব ব্যাপারে বোধহয় আমার বাবার খানিকটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল, কারণ আমার লেখাপড়া বা অন্য কোন ব্যাপারেই তিনি কোনদিনও কোনও বাধা সৃষ্টি করেননি
বরং প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন।
আমাদের
ব্রাহ্ম পরিবার – তখন বেশ আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে। কাজেই আমি বি এ পাশ করবার
পরে বেশ তরতর করে এম এ পাশ করে ফেললাম।
কিন্তু
আমার চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর হয়ে ওঠেনা। এদিকে আমার পুরনো সহপাঠিনীদের
মধ্যে অনেকেই বিয়ে থা করে একবার কেন, বার দুতিন মাতৃত্বের
স্বাদ পেয়ে গেছেন।
আর
আমার মনের মতো তো দূরের কথা, কোন চাকরিই জোটেনা। এমনি করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে
আর বাবার হোটেলে অন্ন ধ্বংস করতে করতে বছর ঘুরে গেল। তারপর একদিন বেড়ালের ভাগ্যে
শিকে ছেঁড়ার মতো একটি চাকরি জুটে গেল। সরকারী
চাকরি। একধরণের জনকল্যাণের কাজও বটে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের মধ্যে নিরক্ষরতার
পরিসংখ্যান করতে হবে, এবং সেই সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের অক্ষর পরিচয়ের ব্যাপারে
উৎসাহ দিতে হবে। কয়েকদিন চৌরঙ্গী পাড়ায় হেড অফিসে হাজিরা দিয়ে কাজকর্ম বুঝে নিতে
হল। তারপর আমার প্রথম কাজ পড়ল হরিনাভি লাইনে একটা ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম –
মাণিকদ – অর্থাৎ মাণিকদহ।
বাড়িতে
এসে কথাটা বলতেই তো বাবা একেবারে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন –
- "আরে
ওই মাণিকদহতেই তো আমাদের বিজয়ের একটা বাংলো, মানে গেষ্ট হাউস আছে। ওখানে ওর একটা
পৈত্রিক জমি ছিল, সেখানে বিজয় বেশ সুন্দর একটা একতলা বাড়ি করেছে। আগে আগে তো সায়েবসুবোদের নিয়ে খুব পার্টি দিত। নতুন যখন বাড়ি
তৈরী হল, তখন আমিও একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। তা সে প্রায় বছর দশেক তো হবেই। মণিকদহ
তে যদি থাকবার দরকার হয় তো ওখানেই থাকতে পারবি।"
বাবা ভাল মনে সাহায্য করতে এলেন কিন্তু আমি তা
খুশী মনে মেনে নিতে পারলাম না। বললাম-
- "বাবা,
চাকরি সূত্রে আমাকে এখন থেকে হয়তো প্রায়ই এদিক ওদিক কত জায়গায় ঘুরতে হবে। সব
জায়গায় তো আর বিজ্যকাকুর বাংলো থাকবেনা।"
বাবা আমার মন খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। তাই বললেন –
- "তা
তো বটেই। রাত্রে থাকার ব্যাপার হলে সে ব্যবস্থা তো তোমায় নিজেকেই করতে হবে। তবে
এটা তোমার প্রথম কাজ। দুদিন ভালোভাবে থাকতে পারলে
কাজটাও ভালো হবে। আর ভালো কাজ করতে পারলে তোমারও শান্তি আর তোমার ওপর-ওয়ালারও
তোমার ওপর আস্থা বাড়বে।"
সত্যি
বলতে কী থাকার ব্যাপার নিয়ে আমারও মনে বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু বাবার কাছে তা
স্বীকার করতে লজ্জা। ভাবখানা দেখালাম যেন বিজয়ককুর বাংলোতে থাকতে আমি অনিচ্ছা
সত্বেও রাজী হলাম। মনে হল বাবা যেন মুখ ফিরিয়ে একটু হাসি চাপলেন। আমিও না দেখার
ভান করলাম।
বাবার
ফোন পাওয়া মাত্র বিজয়কাকু গাড়ি হাঁকিয়ে একেবারে বাংলোর চাবি নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে
হাজির। আমাকে বললেন –
- "তুই
চাবি নিয়ে চলে যা। ষ্টেশনে নেমে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। তবে সঙ্গে তো তোর স্যুটকেস
থাকবে। একটা রিক্সা নিয়ে নিবি। মল্লিক সাহেবের বাংলো বললেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে। এখন একটা গোর্খা বাহাদুর কেয়ার টেকার আছে। ফ্যামিলি কাচ্চা
বাচ্চা আছে বলে বাংলোতে থাকেনা। তবে কাছাকাছিই থাকে। খুব ভালো লোক। এর আগেও একটা
খুব ভালো কেয়ার টেকার ছিলো – শরণ। একা মানুষ, তাই বাংলোতেই থাকতো। ওসব বাগান টাগান
তারই তৈরী। সে আর এখন নেই, এখন এই বাহাদুরই সব দেখাশোনা করে। এও মন্দ নয় – খুব
বিশ্বাসী।"
আমি
বলি –
- "বিজয়কাকু,
তোমার বাড়িটা ফাঁকা পাওয়া যাবে তো? তুমি আবার তোমার কোনও লালমুখো সাহেব বন্ধুকে
ঢুকিয়ে রাখোনি তো?"
বিজয়কাকু তাঁর সেই বিখ্যাত ছাদ ফাটানো অট্টহাসি
হেসে বললেন –
- "আরে
না না। মাণিকদহে কয়েকজন সাদা চামড়া এখনও রয়ে গেছে বটে। ওখানে নদীর জল নিয়ে কী একটা
এঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট এর কাজ চলছিল। আমার
বাংলোর কাছাকাছি একটা মেস বাড়িতে এখনও বোধ হয় দুচার জন আছে। কাজ শেষ হলেই দেশে
ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আছে। তবে আমার বাংলোর পিছনে ফলের বাগান – সেখানে ওদের
কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখলে ঘাবড়ে যাসনা। মানুষগুলো খুবই ভদ্র – এই দুচারটা ফল টল
তুলে নিয়ে যায় আর কী। বাহাদুরটা লোকাল লোকেদের একটা ফুলও তুলতে দেয়না, কিন্ত ফিরিঙ্গীদের
ফলপাকুড় তুলতে দেখলে কিচ্ছুটি বলেনা। তুই কিচ্ছু ভাবিস না – কবে যাবি বল, আমি
বাহাদুরকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
বাহাদুরের
কথায় আমার ভরসা বাড়লো। তবুও বোধহয় আমার মুখখানা একটু শুকনো দেখাচ্ছিলো, কারণ বিজয়কাকু
বললেন –
- "ওদিকে
মাস দুয়েক যাওয়া হয়নি। এই সুযোগে তোর সঙ্গে আমি আর তোর কাকীমাও চলে যেতাম, কিন্তু
পরশু আবার আমরা দুজন তোর কাকীমার বোনঝির বিয়েতে জয়পুর যাচ্ছি। ওখানে পনেরো কুড়ি
দিন তো লেগে যাবেই।"
বাবা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন –
- "না
না সুনু আমাদের খুব স্বাধীনচেতা আর সাহসী মেয়ে। এ তো খুব ভালো ব্যবস্থা – ভয়
কিসের? এর পর থেকে তো সব যায়গায় একাই যেতে হবে। প্রথম থেকে অভ্যেস করাই ভালো। না
হলে তো অফিসে ক'দিন ছুটি নিয়ে আমিই ওর সঙ্গে যেতে পারতাম।"
যাই
হোক তিন দিন পর, একটি ছোট সুটকেসে আমার দু একটি জামাকাপড় এবং একটি ছোট ব্যাগে আমার
অফিসের ফাইল পত্র আর বিজয়কাকুর দেওয়া বাংলোর চাবি নিয়ে আমি দুর্গা দুর্গা বলে রওনা
দিলাম। বাবা ষ্টেশনে এসে আমায় গাড়িতে তুলে দিলেন আর বললেন –
- "এটা
প্রথম বার, তাই ষ্টেশনে এলাম, এর পর তুই একাই আসতে পারবি।"
ট্রেনে
যে কামরায় উঠলাম, সেটাতে খুব ভীড় না থাকলেও কিছু লোকজন ছিল। এতবড় আইবুড়ো মেয়ে একা
একা চলেছে, অনেকেই টেরিয়ে টেরিয়ে তাকালেন, একজন তো আবার সরাসরি ড্যাবড্যাব করে
তাকিয়েই রইলেন। এম এ পড়বার সময় ক্লাসে বেশ ক'জন পুরুষ সহপাঠী ছিলেন, তবে বেশীর
ভাগই বিবাহিত। আমরা তখনকার দিনে তাঁদের সঙ্গে পড়াশোনার কথা ছাড়া অন্য আলাপ আলোচনা
করতাম না এবং আপনি বলে কথা বলতাম। তবে ওরই মধ্যে আমার বান্ধবী আশালতা ও অমরবাবুর
মধ্যে বেশ একটু প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল। বাড়াবাড়ি কিছু নয়। আমি ওসবের মধ্যে নেই।
নিজেকে পুরুষ মানুষের সমকক্ষ ভাবতে ভাবতে প্রায় নিজেকে পুরুষই ভাবতাম।
আশালতা
আমায় বলতো –
- "আচ্ছা
সুনন্দা, তুই এতো কাঠখোট্টা কেন রে? ওই সুদেববাবু তো ঘাড় ঘুরিয়ে সব সময় তোর দিকে
দেখেন। আর প্রফেসর বাগচীর তো মনে হয় ক্লাসে একমাত্র তুইই ছাত্রী আছিস – আমরা সব
অদৃশ্য।"
আমি
ওর কথায় কান দিই না। আমার কোনদিন কাউকে দেখে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি। যদিও রবি বাবুর
লেখা প্রেমের কবিতা গুলো পড়তে ভালোই লাগতো।
যাই
হোক, মাণিকদহ কলকাতার কাছেই। দিনে দিনেই পৌঁছে গেলাম। ষ্টেশনে নেমে দেখি এক গোর্খা
এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললো –
- "আপনি
কি মল্লিক সাহেবের কাছ থেকে আসছেন? সুনন্দা দিদি?"
জিগেস করলাম –
- "হ্যাঁ
আমি সুনন্দা – কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে আমি এই ট্রেনে আসছি?"
আমার
হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিতে নিতে সে জানালো যে ও নাকি সক্কাল থেকেই ষ্টেশনে এসে বসে
আছে। তবে ছোট ষ্টেশন তো – আমার এই গাড়িটাই প্রথম গাড়ি যেটা এই ষ্টেশনে থেমেছে। ওকে
বললাম –
- "তুমিই
তাহলে বিজয়কাকুর বাহাদুর?" বাহাদুর একগাল হেসে মাথা নাড়লো।
দুটো
সাইকেল রিক্সা করা হল। একটাতে আমি, আর একটাতে বাহাদুর আমার ব্যাগ দুটো নিয়ে। প্রায়
মিনিট পনেরো পরে বিজয়কাকুর বংলোর সামনে রিক্সা থামল। ভাড়া মিটিয়ে ভাল করে বাড়িটার
দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। গেটের দুপাশে দুটো লতানো গাছ লাগানো। থোকা থোকা
গোলাপী ফুলে ভর্তি। গেট খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম,
বাড়ির সামনে ভারী সুন্দর বাগান। একটা সুন্দর গাড়ি বারান্দার ওপর একটা ঘর – সে ঘরে
অনেকগুলো কাঁচের জানালা আছে। বাহাদুর
তালা খুলে দিতে ভেতরটাও ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম। মাঝে বেশ বড় একটি হলঘর। সেখানে
খাবার টেবিল চেয়ার এবং বসবার ব্যবস্থাও আছে। হলের দুপাশে দুটি করে সবশুদ্ধ চারটি
ঘর, এবন প্রতিটি ঘরের সংলগ্ন বাথরুম – খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পিছন দিকে টানা
বারান্দা, আর তারপর ছোট্ট একটুকরো বাগান। দেখলাম নানা রকম ফলের গাছ লাগানো হয়েছে।
মনে মনে বিজয়কাকু আর কাকীমার রুচির প্রশংসা না করে পারলামনা।
বাড়ির
বাইরে আমি এর আগে এরকম একা কখনো থাকিনি। হরিদ্বার, রাজগীর, রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত
এসব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি বটে, তবে সব সময়েই বাবা, মা, আমার পরের বোন চারু আর ছোট
ভাই মান্তুর সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসে দেখছি আমার ভয় ভাবটুকু একেবারেই কেটে গেছে।
মনে হয় এত সুন্দর বাংলো আর তার কেয়ার টেকার বাহাদুরকে দেখে।
দুপুরের
ভাত খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। এখন বাহাদুর চা করে দিল। রাত্রে কী খাবো জিগেস
করলো। বাজার করবার টাকা দিতে চাইলে জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে জানালো যে মল্লিক সাহেব
টাকা নিতে মানা করেছেন, টাকা নিলে নাকি ওর চাকরি চলা যাবে। বুঝলাম লোকটা সৎ।
আমি
এরপর পায়ে হেঁটে গ্রামে গিয়ে দুচার জনের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। গ্রামটি সম্পর্কে
একটা খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি একটা ধারণা হল। দুচার ঘর খুব গরীব মানুষ থাকলেও
বাকিদের মনে হয় তেমন খাওয়া পরার ভাবনা নেই। তবে মেয়েদের কেউ অ আ ক খ ও শেখেনি।
সন্ধ্যেবেলা
বাংলোতে ফিরে দেখলাম বাহাদুরের রান্না তৈরী। ওকে বললাম –
- "বাহাদুর তুমি আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রাখো – এতো তাড়াতাড়ি
রাতের খাবার খাওয়ার আমার অভ্যেস নেই।
তার
চেয়ে তুমি বরং এখানে বসো, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি।"
আমি মাঝের হলঘরে সোফায় বসলাম – বাহাদুর বসলো নীচে কার্পেটে।
আমার
প্রথম প্রশ্ন হল –
- "বাহাদুর, তুমি তো বেশ বাংলা বল, কার কাছে শিখলে?"
প্রশংসা শুনে বাহাদুরের মুখে হাসি আর ধরেনা, বলে-
- "কার কাছে আর দিদি, এই চারপাশের লোকজন, বাংলা ছাড়া আর কেউ তো কিছু বলেনা। যখন আমি প্রথম এখানে চাকরিতে
ঢুকি,
তার দুদিনের মধ্যেই শরণ আমাকে বললে –"বাংলাটা
মন দিয়ে শিখে নে, নইলে মুস্কিলে পড়বি।"
- "শরণ? সেই যে আগে এখানকার কেয়ার টেকার ছিল?"
- "হ্যাঁ দিদি, তবে সে ছিল একা মানুষ, ওই ওপরের ঘরে থাকতো – এ বাংলোর খুব দেখভাল করতো। আমার চাকরিও এখানে প্রায়
পাঁচ ছয় বচ্ছর হয়ে গেল।
দেশে
বউকে রেখে এসেছিলাম।
তা
শরণ বলল-
বউ কে দেশে একা ফেলে রেখেছিস কেন, এখানে নিয়ে আয়। তবে ওপরের ওই চিলতে ঘরে
সুবিধে হবেনা- মল্লিক সাহেবকে বলে, কাছাকাছি
আলাদা একটা ঘর দেখে নে।
তা
দিদি আমি তাই করলাম।
কাছাকাছি
একটা ভাঙা চোরা ঘর ছিল, তবে উঠোন কুয়া সব আছে। তা সাহেব শুনে সেই ঘর সারিয়ে
সুরিয়ে দিলেন। বউ
এল,
এখন আমার দুটো বাচ্চা।
বাংলোয়
কেউ না থাকলে দিনে ঘরেই থাকি – আর রাতে লাঠি নিয়ে এসে এখানে
পাহারা দিই।"
পাহারা
দিতে হয় শুনে আমার একটু অবাক লাগল।
এত
নিস্তরঙ্গ গ্রাম, সেখানে পাহারার দরকার? বাহাদুরকে সে কথা জিগেস করতে সে বলল –
- "না দিদি – চোর ডাকাত তো নেই। তবে কিনা এলেই হল। গরীব লোক – পেটের জ্বালায় কী না করে।
সেই
শরণের সময় না কী এক চোর হলঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল, তারপর ধরা
পড়ে শরণের হাতে বেদম পিট্টি খেয়েছিল।"
ওর কথার ধরণে আমি হেসে ফেলি, ওকে বলি –
- "ঠিক আছে বাহাদুর – তুমি এবার বাড়ি গিয়ে খেয়ে টেয়ে এসো। রাতে না হয় আবার পাহারা
দিতে চলে এসো।"
- "হ্যাঁ দিদি, একবার বাড়ি ঘুরে আসি। আমার বউ আর ছোট ছেলেটা দুজনেরই
বুখার হয়েছে। একটু
দেখে আসি।"
একবার
মনে হল বলি, আহা ওদের অসুখ, তোমাকে
আর রাতে পাহারা দিতে আসতে হবেনা।
তারপর
মনে হল
– না না আসুক।
এতো
বড় বাড়ি,
বাইরে না হয় একটা পাহারাদার থাকল। যদি আবার চোর আসে!
বাহাদুর
আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে বাড়ি চলে গেল। একটু পরেই আস্তে আস্তে দিনের
আলো নিভে আসবে। যে
ঘরটিতে আমি থাকবো সে ঘরে এসে শাড়ি জামা পাল্টে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। হাওয়া চলাচলের জন্যে বাহাদুর
সামনের দিকের একটি জানলা খুলে রেখেছে।
সুন্দর
হাওয়া আসছে – রাতে না হয় বন্ধ করে দেব।
কিছুক্ষণ
পর পেছনের বারান্দায় কথাবার্তার আওয়াজ শুনে হলঘরের দরজা খুলে পেছনের বারান্দায় এলাম। ও মা, বারান্দায় বেশ কিছু বেতের চেয়ার আর নীচু নীচু টেবিল পাতা – আর আসর জাঁকিয়ে বসেছে গোটা পাঁচ সাত লালমুখো সায়েব। আমি থতমত খেয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে
–
পা দুটো যেন মাটিতে কেউ পুঁতে দিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও লজ্জা – আবার দৌড়ে পালিয়ে যেতেও লজ্জা। ওরাও যেন খানিকটা অপ্রস্তুত। হঠাত ওদের মধ্যে একজন ভদ্রলোক
উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন।
হাত
মেলাতে গিয়েও দুহাত জোড় করে বললেন –
- "আমি রবার্টসন – এখানকার রিভার প্রজেক্টের চীফ এঞ্জিনিয়র। এঁরা সবাই আমার সহকর্মী
–
আমরা এই পাশেই থাকি।
মিঃ
মল্লিক আমাদের বন্ধু, তাই মাঝে মাঝে আমরা এসে এই বারান্দাতে
এসে বসি।"
তারপর
উনি খোঁজ নিলেন আমি কে, এই গেস্ট হাউসে থাকছি কী না। আড়চোখে দেখলাম, ওঁদের নীচু টেবিলে সরু সরু লম্বা লম্বা বোতল। যাইহোক, ইতিমধ্যে আবার একজন অত্যুৎসাহী মধ্যবয়সী সায়েব এগিয়ে এসেছে। নিজের পরিচয় দিল মাইক হ্যামিল্টন
বলে। আমাকে
"সুন্দরী মহিলা" বলে সম্বোধন করে আমার
নাম জিগেস করল।
জিগেস
করল আমি মিঃ মল্লিকের আত্মীয় কি না, কেন এখানে এসেছি
– ইত্যাদি।
বুকের
মধ্যে ধুপ ধুপ করলেও ইংরাজীতে বেশ সপ্রতিভ ভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারার জন্যে
মনে মনে বেশ গর্ব অনুভব করছিলাম।
একবার
মনে হল,
ইস্ বাবা যদি এখন আমাকে দেখতে পেতেন! হঠাত মাইক
নামে সাহেবটি বলে বসল –
- "তুমি আমাদের ভেতরে এসে বসতে ইনভাইট করবেনা?"
এবার
আমার অপ্রস্তুত হবার পালা।
আমাকে
বাঁচালেন রবার্টসন। মাইকের
হাত ধরে টেনে বললেন –
- "আঃ মাইক! এই লেডি কে বিরক্ত কোরনা – চলো এখান থেকে।"
যেতে যেতে মনে হল শুনলাম ওঁর চাপা গলার ধমক – "স্বভাব আর গেলনা তোমার।"
বাকিটুকু কী বলছেন শোনার জন্যে আমি কী আর সেখানে দাঁড়াই? এক দৌড়ে ঘরে এসে বারান্দার দরজাটা বেশ ভাল ভাবে বন্ধ করে দিলাম।
ঘরে
বসে আস্তে আস্তে নিজেকে বোঝালাম, এসব ছোটখাট ঘটনাই তো তোমার অভিজ্ঞতার
ঝুলি ভরিয়ে তুলবে।
ঘাবড়ে
যাবার মতো এমন কিছুই তো হয়নি।
এম
এ পড়বার সময়ও তো ইউনিভার্সিটিতে কত ছেলে ছোকরা বিরক্ত করেছে। তবে পেছনের বারান্দায় হলঘরের
দরজার ঠিক ওপাশে কয়েকটি বিদেশী লোক বসে বসে মদ্যপান করছে – সেটা ভেবেই অস্বস্তিতে মনটা ভরে রইল। যাই হোক মিনিট দশেক পরেই
বারান্দায় কথাবার্তার আওয়াজ বন্ধ হল, জোর গলায় কয়েক
দফা গুড নাইট গুড নাইট শুনে বুঝলাম ওরা চলে গেল। এতক্ষণ নিজের ঘরে কাঠ হয়ে
বসেছিলাম
– এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এতক্ষণে ক্ষিদে বোধ হওয়াতে
বাহাদুরের ঢাকা দিয়ে রেখে যাওয়া খাবার টেবিলে বসে খেয়ে নিলাম। এই সময়টা বাবা, মা, ভাই, বোন – এদের কথা খুব মনে পড়ছিল।
জীবনে
এই প্রথম বোধহয় আমি একা বসে খাচ্ছি।
ভাবলাম
খাওয়ার পর সামনের উঠোনে অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বসি, কিন্তু ধরাতলে উঠোনের চারপাশে বাগানে ফুলের সমারোহ এবং আকাশে বেশ গোলগাল রুপোর
থালার মতো চাঁদ – সব মিলিয়ে মনে হল কোন কাজ না করে চুপচাপ বসে
একাকীত্বও বেশ উপভোগ করার মতো জিনিষ।
কাগজপত্র
না হয় আজকের মতো ব্যাগেই বন্দী থাকুক।
উঠোনের
একধারে একটি খাটিয়ায় চাদর পাতা।
ঢাকা
গাড়ি বারান্দা ছেড়ে খোলা আকাশের নীচে ওই খাটিয়ায় গিয়ে বসলাম, এবং কিছুক্ষণ পরে শুয়েও পড়লাম। সব মিলিয়ে পরিবেশটা এত সুন্দর! যারা চিরকাল কলকাতায় মানুষ, তাদের কাছে এ যেন এক রূপকথার রাজ্য আর আমি যেন
এক রাজকন্যা।
কলকাতার
আকাশ ঘোলাটে। এখানকার
আকাশ পরিষ্কার তাই অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে।
মনে
হচ্ছে মাথার ওপর কেউ যেন জরির সামিয়ানা খটিয়ে দিয়েছে।
সারাদিনের
নানা ঘটনা হয়ত আমার স্নায়ুকে ক্লান্ত করে ফেলেছিল। চোখ বুজে সারাদিনের নানা
কথাই ভাবছিলাম। মিষ্টি
একটা হাওয়ায় নাম না জানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে – অদ্ভুত একটা আবেশ। একটু বোধহয় চোখ লেগে গিয়েছিল। তার মধ্যে মনে হল গাড়ি বারান্দার
ওপরের ঘরটাতে কে যেন জানলা বন্ধ করছে।
আধোঘুমে
দেখি
– হ্যাঁ, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে এবং একজন মানুষ
একটার পর একটা জানলা বন্ধ করছে।
জানলাগুলোতে
কাঁচ লাগানো, তাই তাকে আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। শেষের জানলাটা বন্ধ করতে
গিয়ে সে আমায় দেখতে পেল।
হঠাৎ
থমকে গিয়ে সে আমার দিকে তাকালো।
ও
হরি,
এই বোধহয় সেই শরণ - শরণ সিং। শিখ পাঞ্জাবী, কারণ মাথায় পাগড়ি আছে। ছেলেটি হয়তো আমারই বয়সী
হবে। সুশ্রী মুখ, হালকা গোঁফ দাড়ি – আর অদ্ভুত কাজলকালো মায়াময় দুটো চোখ। তার চোখ
দুটো এত আশ্চর্য যে আমি যেন চোখ ফেরাতে পারলাম না। সোজা তার দিকে চেয়ে রইলাম। আমি
ভুলে গেলাম যে আমি একজন শিক্ষিতা চাকরি করা আধুনিক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে, আর এই
ছেলেটি একজন সামান্য কেয়ার টেকার।
তাকিয়ে
থাকতে থাকতে এই অচেনা ছেলেটির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসায় আমার বুকের ভেতরটা ভরে উঠল।
সারা গায় কেমন যেন এক শিউরে ওঠা অনুভূতি। সেও
সোজা নীচে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুখে অল্প হাসি। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানিনা। দশ
সেকেন্ড? দশ মিনিট? ওইটুকু সময় মনে হল আমার সারা জীবনের যত না বলা কথা সব বলা হয়ে
গেল – আর সেও যেন সব কথা বুঝে নিল। তার জন্যে আমার বুকের ভেতরটা যে ভালোবাসায় ভরে
গেছে – সে যেন জেনে গেল। মনে হল এই বিপুল বিশ্ব চরাচরে আর কিছুরই কোন দাম নেই – nothing
matters, শুধু ওই মানুষটি আর আমি। এই কি প্রেম? আমার প্রথম প্রেম?
'এসেছ প্রেম এসেছ আজ কী মহা সমারোহে'। আমার একবারও মনে হলোনা – ও যে কে আমি তো তাই
জানিনা। বরং মনে হল, ওই দুটো চোখ যেন আমার জন্ম জন্মান্তরের চেনা। দুজনে দুজনের
দিকে তাকিয়ে এভাবে কতক্ষণ কাটলো জানিনা – একসময় সে বলল – "অব চলেঁ?" ও
আমায় জিগেস করছে এবার ও যেতে পারে কিনা। আমার মন যেন কানায় কানায় ভরে আছে। আমি
চোখের পলক ফেলে সম্মতি জানালাম, চাদরটা আরো ভালো করে গায়ে টেনে নিলাম। শেষ জানলাটি
এবার বন্ধ হয়ে গেল – বন্ধ হওয়ার আগে যেন শুনলাম বলল – "আপ অন্দর যা কে সো
যাইয়ে।" তারপর ওপরের ঘরের আলো নিভে গেল।
ও
চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার বাইরে থাকার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল। হাওয়ায় একটু শীত
শীত করতে লাগল। আমি ঘুম চোখে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে তখনই ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাত
নিশ্চয় পেরিয়ে গেছে – একবার যেন কী সব আওয়াজে ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এল। আমার ঘরের
জানলাটা কি কেউ খুলে দিয়ে গেল? না তো -। বাইরে
কী কোন আওয়াজ?
আমি
আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম – সেই লালমুখো মাইককে-
দাঁত বের করে অসভ্যের মতো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাহাদুরের লাঠির ঠকঠক আওয়াজে ঘুম
ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। উঠে জল খেলাম, ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত দেড়টা। আমার ঘরের
জানলাটা শোবার সময় বন্ধ করিনি – দেখলাম সেটা বন্ধ। বোধহয়
বাহাদুর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। বাহাদুর না শরণ? শরণ কি এখনও ওপরের ঘরটাতে
থাকে? শরণের কথা – ওর চোখ দুটোর কথা – ভাবতে ভাবতে আবার ঘুম এসে গেল।
ভোর
বেলা ঘুম ভাঙল – পেছনের বাগানে হৈ চৈ এর শব্দে। গতকাল বিকেলে আমার যা অভিজ্ঞতা
হয়েছে- আমি আর দরজা খুলে বাইরে যাইনি। কী দরকার – আমি আমার নিজের চরখায় তেল দিই। ঘন্টা
খানেক পর বাহাদুর চা নিয়ে আমার ঘরের বাইরে থেকে ডাকল। আমিও ততক্ষণে মুখ টুখ ধুয়ে
স্নান সেরে তৈরী হয়েই নিয়েছি।
হলঘরে
চা খেতে খেতে ভাহাদুরের কাছে যা কাহিনী শুনলাম, তাতে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। গতকাল
সন্ধ্যা বেলা বাহাদুর তার বাড়ি গিয়ে দেখে যে তার বউ আর ছোট ছেলেটার ধুম জ্বর। বড়
ছেলেটার বয়েস পাঁচ বছর – একা বসে কাঁদছে। ডাক্তার বাবুর বাড়ি থেকে দাওয়াই এনে ওদের
দিয়ে, তারপর রুটি বানিয়ে অদের খাইয়ে নিজে খেয়ে বাহাদুরের নাকি একটু চোখ লেগে
গিয়েছিল। হঠাত শরণের ডাকে ওর ঘুম ভেঙে যায়।
- "ব্যাটা
তুই ঘরে ঘুমোচ্ছিস আর বাংলোয় দিদিমণি একা রয়েছে। দাঁড়া এবার তোর চাকরি কেমন থাকে
দেখবো।"
এই
শুনে তো বাহাদুর পড়িমরি করে লাঠি হাতে পাহারা দিতে হাজির। এসে দেখে সব ঠিকঠাকই
আছে। বাংলোর সব দরজা জানলা বন্ধ। তাও ও সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে।
ভোরবেলা
গোয়ালা দুধ দিতে এসে বলল –
-
"বাহাদুর, তোর বাগানে ঝোপের ধারে এক ব্যাটা সায়েব মদ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।"
সেই
শুনে বাহাদুর দৌড়ে গিয়ে দেখে মাইক-সায়েব মদ খেয়ে পড়ে নেই
– অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
সারা
গায়ে লাল নীল মারের দাগ, গলায় পাঁচ আঙুলের ছাপ। বাহাদুর তখন তাড়াতাড়ি ওই
সাহেবদের মেসে গিয়ে খবর দিয়ে অন্য সাহেবদের ডেকে আনে। তারা এসে জলের ঝাপটা দিয়ে
ওর জ্ঞান ফিরিয়ে ধরাধরি করে ওকে তুলে নিয়ে যায়।
বাপ্রে
এসব কী কান্ড! আমি তখনই ঠিক করলাম এখানে আর নয়। আজই কলকাতার প্রথম ট্রেনেই
বাড়ি ফিরে যাবো। চা
জলখাবার খেয়ে বাহাদুরকে সব কথা বলতে সে একটু অপ্রস্তুত মুখে চুপ করে থাকলো, তারপর আরও অনেক কথা বলল।
মনে
মনে হয়তো নিজেকে দোষী ভাবছে ঠিক সময় পাহারা দিতে না আসার জন্য। তবু শরণ ঠিক সময় ডেকে দেওয়াতে
অন্তত দেড়টায় এসেছে।
সারারাত
পাহারা না দিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে থাকলে মল্লিক সাহেব ওকে লাথি মেরে দূর করে দিতেন। শরণের কাছে ও কৃতজ্ঞ। প্রথম প্রথম ও শরণকে আমল
দিতনা,
কিন্তু এখন ও শরণকে ভালোবাসে, ভক্তি করে। আমি বাহাদুরকে জিগেস করলাম –
- "তোমার শরণ কি ওপরের ওই ঘরটাতে থাকে?" ও অবাক হয়ে
বলল –
- "না তো!"
আমি
মনে মনে হাসলাম।
বাহাদুর
তো জানেনা, কিন্তু আমি জানি – কাল
শরণ ওর পুরনো ঘর দেখতে এসে আমাকে দেখেছে। যাবার আগে আর একবার দেখা
হবে কি?
হাতে একটু সময় আছে।
গোছগাছ
সেরে ভাবলাম, একবার মাইকের খবর নিয়ে যাই। দেখলাম, ওদের মেসের সামনেও একটু জটলা। ডাক্তার এসেছেন, শুনলাম পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছে। সায়েব মার খেয়েছে বলে কথা! হয়তো কোন আতংকবাদীর কাজ।
আমাকে
দেখে কালকের সেই বয়স্ক সাহেবটি – মিঃ রবার্টসন এগিয়ে এলেন। ওঁকে মাইকের খবর জিগেস করলাম। উনি বললেন –
- "জ্ঞান ফিরেছে, তবে গলায় খুব ব্যথা – কষ্ট করে কথা বলছে।
আর
কী
– বদমাইশির শাস্তি হয়েছে।"
আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে উনি বললেন –
- "বলতেও খুব লজ্জা পাচ্ছি।
কাল
রাতে আমরা সব ঘুমিয়ে পড়লে মাইক বাংলোয় গিয়েছিল। তোমার ঘরের জানলা খোলা দেখে
ওর বিকৃত মন ভেবে নেয় যে তুমি বুঝি ওর জন্যেই জানলা খুলে রেখেছো। সে জানলা দিয়ে তোমার ঘরে
ঢুকেছিল
– কিন্তু বাইরে থেকে কে যেন ওর গলা ধরে হিঁচড়ে ওকে বাইরে টেনে আনে। তারপর মুখ চেপে বাংলোর পিছন
দিকের বাগানে নিয়ে এসে প্রচন্ড মারে এবং গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। সারা রাত ও ওখানেই অজ্ঞান
হয়ে পড়েছিল। ভাগ্য
ভাল,
এ যাত্রা প্রাণে বেঁচেছে। পরের সপ্তাহে দেশে ফিরে
যাব,
জাহাজের টিকিট কাটা।
লন্ডনে
ওর স্ত্রী আর তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ওর পথ চেয়ে বসে আছে।"
আমি অবাক হয়ে জিগেস করলাম –
- "কে এমন কাজ করল, কিছু জানা গেল? মাইক কি লোকটাকে চিনতে পেরেছিল?"
রবার্টসন বললেন –
- "না লোকটিকে
ও চিনতে পারেনি, শুধু বলেছে,
He
had a turban on – তার মাথায় পাগড়ি ছিল।"
আমি চমকে
উঠলাম। বলতে না
চাইলেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল –
- পাগড়ি ছিল?
তার মানে শরণ?
শরণ সিং? কাল ও এখানে ছিল। মাইকের হাত থেকে কাল ওই তাহলে আমাকে বাঁচিয়েছে।"
মিঃ রবার্টসন
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন –
- "শরণ সিং? এই বাংলোর আগেকার কেয়ার টেকার? কী বলছো তুমি মিস্? সে তো কত বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে
মারা গেছে!"
মারা
গেছে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কাল রাতে ওপরের ঘরে আমি
তাহলে কাকে দেখেলাম? কে তাহলে আমাকে মাইকের কাছ থেকে
বাঁচালো? কার কাজলকালো চোখের দৃষ্টিতে আমার বুকের মধ্যেটা এমন
ওলটপালট হয়ে গেল? আর বাহাদুর? সেও তো
… না না সে মারা যায়নি – সে আমাদের আশেপাশেই আছে। শুধু আমি কোনও দিনও তার
কাছে যেতে পারবোনা। আমার
দুচোখ জ্বালা করে চোখে জল এল।
চোখের
জল লুকোতে আমি দৌড়ে আমার ঘরে চলে এলাম।
আর
কখনো শরণের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
তবু
শরণ আমার প্রথম প্রেম।
শরণ
আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে।
আমার
শুকনো মনে সরসতা এনেছে।
প্রথমবার
একা বাইরে গিয়ে মাইক হ্যামিল্টন সম্পর্কিত এই অভিজ্ঞতার ফলে সে চাকরি করা আর আমার পক্ষে
সম্ভব হয়নি। বাড়ির
কাছেই একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াবার কাজ পেয়েছিলাম। এর আট মাস পরে আমি বিয়ের
পিঁড়িতে বসলাম। বাবা, মা, বিশেষ করে মা আমার মনের এই পরিবর্তনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
নাতনিকে
বললাম –
- "তোমার দাদুকে বিয়ে করতে কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? দেখেছিলাম
ওর চোখদুটো – অদ্ভুত মায়াভরা। বুঝেছিলাম এর সঙ্গে আমার
মনের মিল হবে। তাই
বলছি দিদিভাই, প্রথম প্রেম কী কেউ ভুলতে পারে? আর ভোলার দরকারই বা কী? এখন হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে,
কিন্তু পরে দেখবে সেই স্মৃতিতে কোনও বেদনা নেই। একদিন তুমিও হয়তো তোমার
প্রথম ভালোলাগার কথা তোমার নাতনিকে গল্প করে বলবে।"
সুদীপ্তা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল –
- "দিদা You are my best friend…" আমি বললাম
–
- "ভাগ্যিস বিয়ে করেছিলাম, নইলে তোমার মতো এমন Friend
আমি পেতাম কোথায়?"

1 comment:
perfect halloween story!
Post a Comment