এ গল্প আজকের নয়।
এ গল্প আজ থেকে প্রায়
একশ বছর আগেকার গল্প।
সুরেন্দ্র নাথ মুখুজ্যে হাইকোর্টের দুঁদে উকিল।
বয়স ৫০ ।
জীবনের প্রথম দিকে
দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন অনেক, তবে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে উন্নতিও করেছেন বেশ তাড়াতাড়ি।
সম্পত্তি যা করেছেন
এখন দুই তিন পুরুষ বসে খেতে পারবে। ভবানীপুরে বিশাল
বাড়ি। বড় দুই ছেলে দীনেন্দ্র নাথ আর দেবেন্দ্র নাথের বিয়ে
দিয়েছেন,
এখন ছোট ছেলে নীতীন্দ্র
নাথের বিয়ের কথা চলছে। স্ত্রী মনোরমা মারা
গিয়েছেন আজ চার বছর। বড় বৌমা আর মেজ
বৌমা খুবই সুশৃঙ্খল ভাবে সংসার পরিচালনা করে।
তাঁর খাওয়া দাওয়া
বা কোন ব্যাপারেই কোন অসুবিধে নেই। এমন কী যখন তিনি
ঘড়ি ধরে ঠিক নটায় স্নানের ঘরে ঢুকবেন, তার আগেই মেজবৌমা গিয়ে তাঁর স্নানের জল, কাচা গামছা, সাবান সব গুছিয়ে
রেখে আসবে। বড় বৌমা তখন রান্না ঘরে ঠাকুরের সঙ্গে ব্যস্ত তাঁর
খাবারের যোগাড় করতে। সুরেন মুখুজ্যে খেতে
বসবেন ঘড়ি ধরে ঠিক দশটায়। তারপর কোর্টের উদ্দেশ্যে
রওনা দেবেন। ড্রাইভার মাধব তাঁর ব্যাগ, টিফিন সব গাড়িতে
তুলে নেবে।
না অসুবিধে কিছু নেই, তবু সুরেন মুখুজ্যে
মনোরমার অভাব অনুভব করেন বৈ কি। এই যে নীতিনের বিয়ে
দেবেন,
একটা পরামর্শ করবেন
কার সঙ্গে। বড় ছেলে দীনেন্দ্র নাথের বয়স ২৬, দু ছেলে মেয়ের বাপ- হলে কী হবে, এখনও তাঁকে যমের মতো ভয় করে চলে।
মেজ দেবেন্দ্রেরও
প্রায় একই অবস্থা। ওরই মধ্যে ছোটটা তাও একটু কথা বার্তা বলে কিন্তু তার
বিয়ের আলোচনা তো আর তারই সঙ্গে করা যায়না! তাছাড়া সে একটু
অন্য ধরণের মানুষ। দিনরাত নাটক সিনেমা এইসব নিয়েই আছে।
কন্দর্প কান্তি রূপ, মানায়ও ভালো।
না সুরেন মুখুজ্যে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন।
বড় বৌমা মেজ বৌমা
দুই বোন। তারা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে।
ছোট ছেলের বৌ আনবেন
গরীব ঘর থেকে,
যাতে সে বড় দুজনকে
মেনে চলে। সংসারে শান্তি বজায় রাখাটা খুব জরুরি।
এসব কথা মুহুরি বাবুকে
বলায় ফল ফললো। ছোট ছেলে নীতিনের জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ এল।
বাংলা দেশে গরীব
ঘরের মেয়ের তো আর অভাব নেই! খুব গরীব তবে উচ্চ কুলীন বংশ।
এক রবিবার দেখে গাড়ি
নিয়ে পাত্রী দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়িতে কাউকে কিছু
বললেন না। যদি ঘর বংশ চেহারা পছন্দ না হয়? সব দিক দিয়ে মেয়ে
যদি তাঁর নীতিনের উপযুক্ত হয়, তবেই বাড়িতে জানাবেন।
উত্তর কলকাতার গলির মধ্যে ভাঙ্গাচোরা বাড়ি।
মনে হয় এক কালে অবস্থা
ভালো ছিল। এখন তালপুকুরে ঘটি ডোবেনা।
সুরেন মুখুজ্যে নিজে
খুব সাধারণ অবস্থা থেকে বড় হয়েছেন। মেয়ের বাপের টাকা
আছে কী নেই,
তা নিয়ে মাথা ব্যথা
নেই। আসল হল শিক্ষা দীক্ষা - বংশ পরিচয়।
মেয়ের বাবা এসে আপ্যায়ন করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।
গরীব হলেও পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন ঘর দোর
- চারিদিকে
লক্ষী শ্রী। সুরেন বাবু চারদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
ক্রুশের কাজ করা
টেবিলের ঢাকা,
বইএর তাকে প্রচুর
বই। মেয়ে নাকি বই পড়তে ভালোবাসে।
মনে মনে হাসেন, নীতিনের সঙ্গে মনের
মিল হবে।
মেয়েটির
মা আজ বছর দুয়েক হল মারা গেছেন। তারপর থেকে ওই মেয়েই
বাপকে আগলে রেখেছে।
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর মেয়ের বাবা একটু উঁচু
গলায় ডেকে বললেন –
- “ও মা নীহার, একবার এদিকে এ ঘরে
এসো। সুরেন বাবুর জন্যে চা টা নিয়ে এসো মা।”
তারপর সুরেন
বাবুর দিকে ফিরে বললেন –
- “নীহার সব জল খাবার
নিজের হাতে বানিয়েছে। বড় শান্ত মেয়ে আমার, লেখা পড়াও জানে।”
মিনিট পাঁচেক পরে একটি রোগা ছিপছিপে মেয়ে চা আর জলখাবারের
থালা হাতে, এক গলা ঘোমটা দিয়ে ঘরে ঢুকলো। যেভাবে খাবার সাজিয়েছে, দেখে নীহার বালার
রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম
করে হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলো।
চায়ের কাপে
চুমুক দিয়ে সুরেন বাবু বললেন –
- “বাঃ মেয়ে দেখতে এসেছি, ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকা থাকলে দেখবো কি করে?”
মেয়েটি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, এখন তাঁর পায়ের কাছে
বসে পড়ে ঘোমটা সরিয়ে দিল। সুরেন বাবু তার মুখের
দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। একি! মেয়ের গায়ের রঙ বেশ
কালো,
চোখ ছোট, সামনের দাঁত দুটোও
যেন উঁচু। কাপের চা খানিকটা চলকে ডিসে পড়লো।
তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে মেয়ে দেখে বেড়ানোর নিতান্ত
বিরোধী। কিন্তু তাই বলে তাঁর রাজপুত্রের মতো রূপবান ছেলের
জন্যে এই মেয়ে!
মনে মনে মুহুরি ব্যাটার
মুন্ডপাত করতে করতে মেয়েটিকে বললেন-
- “তুমি এখন ভেতরে যাও, যা দেখবার আমি দেখেছি।”
মেয়েটি
উঠে তাঁকে আর এক বার প্রণাম করে আস্তে আস্তে ভেতরে চলে গেল।
সুরেন বাবু
চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে রেখে শুকনো গলায় বললেন –
- “আমি আসি তা হলে।”
ঠিক
সেই সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটলো।
মেয়ের বাবা হঠাৎ
কেঁদে উঠে সুরেন বাবুর পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন।
- “আমাকে দয়া করুন সুরেন
বাবু,
রোগা বলে দেখতে ছোট
লাগে,
আসলে নীহারের পনের
বছর বয়েস হয়েছে। আমি একে গরীব, তায় মেয়ের রঙ কালো।
যেই দেখে, সেই মুখ
ফিরিয়ে নেয়। এরপর আমাদের কুলীনের ঘরে মেয়ে অরক্ষণীয়া হয়ে যাবে।
খুব লক্ষী মেয়ে আমার, রান্না বান্না ঘরের
কাজ সমস্ত জানে। আপনি দয়া করে আপনার পায়ে ওকে স্থান দিন।”
- “আরে আরে - কী করছেন
আপনি,
শিগ্গির পা ছাড়ুন।
আমার ছেলেকে আপনি
দেখেন নি,
তার সঙ্গে নীহারকে
একেবারে মানাবেনা। জোর করে চাপালে কেউ সুখী হবেনা।
আর আমার ছেলেই বা
কী মনে করবে?
তার দাদাদের বেলা
বড় ঘর দেখে সুশ্রী চেহারা দেখে মেয়ে এনেছি আর আজ তার মা বেঁচে নেই বলে …”
- “সেকথা আমি জানি সুরেন
বাবু
.. আপনি
বিপত্নীক
- আপনি
নীহারকে আপনার পায়ে স্থান দিন।
এই
গরীব ব্রাহ্মণকে কন্যাদায় থেকে আপনি উদ্ধার করুন।”
সুরেন বাবু
আকাশ থেকে পড়েন –
- “মশাই আপনার কী মাথা
খারাপ হয়েছে?
আমার বয়েস পঞ্চাশ - ঘরে বড় বড় তিন
ছেলে। নাতি নাতনি--”
- “সব জানি সুরেন বাবু।
আপনি উদ্ধার না করলে
আমাদের দুজনকে আত্মহত্যা করে মরতে হবে। কুলীনের ঘরে এই সেদিন
অব্দি পুরুষেরা একশো দুশোটা করে বিয়ে করতো।”
- “পা ছাড়ুন - আগে পা ছাড়ুন বলছি
... কী মুস্কিল -।”
- “আপনি কথা দিন, আমার নীহারকে আপনি
পায়ে স্থান দেবেন। ঘরের কাজকর্ম সব করবে, একপাশে পড়ে থাকবে।
খুব শান্ত, খুব লক্ষী মেয়ে আমার…”
- “আঃ পা ছাড়ুন বলছি।
ছেলের জন্য মেয়ে
দেখতে এসে আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি - এমনটি হবে জানলে
আমি কক্ষনও মশাই এমুখো হতাম না।”
এবার
হতাশ হয়ে নীহারের বাবা পা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
মাথা নীচু করে ধুতির
খুঁটে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন –
- “আপনার চারদিকে এত
নাম ডাক,
শুনেছি গরীব মানুষের
হয়ে আপনি বিনা পারিশ্রমিকে মামলা লড়েন। আপনার দয়ার শরীর - মনে বড় আশা ছিল....গরীব ঘরেও সম্বন্ধ
খুঁজেছি। সেখানেও কেউ দয়া করেনি।
আমি মরলে ওই অরক্ষণীয়া
মেয়েকে কে দেখবে?
আমাদের আর আত্মঘাতী
হাওয়া ছাড়া অন্য উপায় রইলো না।”
সুরেন্দ্র নাথের মনে কোথায় যেন বাজলো।
এক কালে তিনিও গরীব
ছিলেন,
তাঁর মেয়ে কী বোন
থাকলে তাঁকেও এই অবস্থায় পড়তে হোত। কিন্তু নীতিনের সঙ্গে
এই মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ তিনি করতে পারবেন না।
ঠিক আছে তিনি নিজেই
নীহারকে বিয়ে করবেন। কথা দিয়ে ফেললেন।
বাড়ি ফিরে শরীর ভালো নেই বলে রাতে কিছু খেলেন
না। সারা রাত বিছানায় ছটফট করে সকাল হতে ছেলে বৌ দের ডেকে
পাঠালেন। তারপর সব কথা খুলে বললেন।
রাশভারী মানুষ, কেউ তাঁকে কোন প্রশ্ন
করলো না,
শুধু চুপচাপ শুনে
গেল।
তিন ছেলের মনে তিন রকম প্রতিক্রিয়া হোল।
বড় ছেলে মনে ভাবলো
এই বয়সেও বাবার এখনও শরীরের চাহিদা রয়েছে। মেজ ভাবলো - মেয়ের বাপটা তো খুব
ধড়িবাজ। ভুজুং ভাজুং দিয়ে কেমন বাবাকে পটিয়েছে।
আর ছোট ভাবলো, আহা রে, মা মারা যাওয়ার পর
বাবা কত একা হয়ে গেছে। আমরা সব যে যার তালে
ব্যস্ত,
বাবার দিকটা কেউ
দেখিনি। তবে একটা পনের বছর বয়সের বাচ্চা মেয়ে - এই যা।
বৌদি দের বোঝাতে
হবে,
যাতে নতুন মানুষটার
কোন অযত্ন না হয়।
দিন দশেক বাদে সুরেন বাবু বিয়ে করে নীহার বালাকে
বাড়ি নিয়ে এলেন। কোন অনুষ্ঠান নয়, খাওয়া দাওয়া নয়; তবে হ্যাঁ - বাড়ি ঢোকার সময় বৌমারা শাঁখ বাজিয়েছিল বটে।
পাড়া পড়শীরা গা
টেপাটেপি করে হাসলো। সুরেন মুখুজ্যের
পেটে পেটে এই ছিল!
তবে সেকালে এই ধরণের
ঘটনা তো আকছার ঘটতো, তাই এ নিয়ে আর বেশীদিন কেউ তেমন মাথা ঘামালোনা।
সুরেন বাবুর নির্দেশে তিন তলার একটা ঘর খালি করে
তাতেই নতুন খাট বিছানা দিয়ে সাজিয়ে নীহারকে থাকতে দেওয়া হল।
আর সুরেন বাবু দোতলায়
যেমন নিজের ঘরে একা থাকতেন, তেমনই রয়ে গেলেন।
আদালত থেকে ফিরে
মাঝেসাঝে নীহারকে ডেকে পাঠিয়ে জিগেস করতেন, তার কোন কিছু দরকার
কিনা,
এ বাড়িতে কোন অসুবিধে
হচ্ছে কিনা। ব্যস্ ওই পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে নীহার নিজেই কিছু কিছু দায়িত্ব নিজের
কাঁধে তুলে নিল। মেজ বৌ এর বাচ্চা হবে, শরীর ভালো নয়, তার কাজগুলো এখন
নীহার করে। দিনের বেলা এক ফাঁকে গিয়ে সুরেন বাবুর ঘর গুছিয়ে দিয়ে
আসে। রান্নার ঠাকুরকে বলে নানা রকম জল খাবার বানায়।
আস্তে আস্তে এক সুরেন
বাবু ছাড়া সকলেই নীহারকে আপন করে নিল। কিন্তু বয়সে অত ছোট
একটা মেয়েকে কোন ছেলে মা বলে কোনদিন ডাকলোনা।
নীহার তাতে কিছু
মনে করেনা; মনে করবে কী, সে নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় পেয়ে যেন বর্তে গেল।
ওর বিয়ে দিয়ে ওর
বাবা গ্রামে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। সুরেন বাবু মাসে
মাসে মনি অর্ডার করে কিছু টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
কিন্তু তা প্রথম
মাসেই ফেরত এল। নীহারের বাবা টুকটাক পৌরহিত্য করেন, একা মানুষের দিব্যি
চলে যায়।
দশ বছরের মাথায় সুরেন বাবু দেহ রাখলেন।
নীহারের ২৫ বছর বয়সেই
শাঁখা সিঁদুর ঘুচলো এবং সে একাদশী ইত্যাদি সব রকম নিয়ম কানুন মেনে সাদা থান পরে বৈধব্য
পালন করতে লাগলো। ধীরে ধীরে নীহার বালার অস্তিত্ব এ বাড়িতে কেউ যেন
আর মনে রাখলোনা। এর মধ্যে ছোট ছেলে নীতিনের বিয়ে হয়েছে, মধ্যবিত্ত পরিবারের
সুশ্রী মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে। নাট্য জগতে তার এখন
বেশ নাম ডাক। সিনেমাও করে - টুকটাক রাজনীতিও
করে। মেজ দেবেনের একটি ছেলে মনোময় আর নীতিনের দুই মেয়ে
আর একটি ছেলে শুভময়।
নীহার তার বাবার মুখের সঙ্গে কেন যেন শুভময়ের
মুখের মিল পায়। তাই তার বিশ্বাস ওর বাবা ই মায়া কাটাতে না পেরে মেয়ের
কাছে ফিরে এসেছেন। শুভময়কে বড় ভালোবাসে ও।
সন্ধ্যেবেলা শুভ
নীহারের কাছে শুয়ে গল্প শোনে।
লুচি, মোহন ভোগ, সাবুর পায়েসে ভাগ
বসায়। ছোট ছেলেটির মনে নানা প্রশ্ন –
- “তুমি তো আমার ঠাকুরমা, তাহলে তুমি আমার
বাবার মা। তবে বাবা তোমার সঙ্গে কথা বলেনা কেন? তোমায় মা বলে ডাকেনা
কেন?”
নীহার চুপ করে থাকে। তার কখনো স্বামী সংসর্গ হয়নি। এ জীবনে তার মা হওয়া হোলনা। তবু এই
প্রৌঢ় বয়সে এসে, নির্জন অবকাশে কখনো কখনো তার সমগ্র অন্তরাত্মা যেন মা ডাক শোনবার
অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকে। ছেলেরা মা বলে স্বীকৃতি তাকে কোনদিন দেয়নি। এক বারের
জন্যেও কেউ তাকে মা বলে ডাকেনি।
নীহার বালা শুভর মাথায় হাত রাখে, তারপর আস্তে
আস্তে বলে –
- “ডাকে সোনা আমার, মনে মনে ডাকে।
তাই তুমি শুনতে পাওনা।”
- “হুঁঃ পাইনা আবার! আমি কানে শুনিনা নাকি?”
- “আচ্ছা, ও কথা থাক।
আচ্ছা এবার বলোতো
মানিক আমার
- আমি মরলে তুমি আমার শ্রাদ্ধটা করবে তো?"
শুভময় শ্রাদ্ধ কাকে বলে জানে।
আড় চোখে রেকাবে
রাখা চন্দ্রপুলিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে-
- “হ্যাঁ…….করবো আবার না … খুব করবো ….”
দিন যায়।
শুনেছে কর্তা জীবন
সত্ত্ব করে দিয়ে গেছেন, অর্থাৎ নীহার যতদিন বাঁচবে, তাকে এ বাড়ি থেকে
কেউ তাকে সরাতে পারবেনা। তিন বৌ মিলে সংসার
পরিচালনা করে,
নীহারের তেমন কাজ
নেই। তিন তলায় তার নিজের ঘরটির একপাশে তার ঠাকুরের আসন।
পুজো করে।
ছাতে টুকটাক বাগান
করে। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে পড়ে।
এই ভাবে এ বাড়িতে নীহারের ৫০ বছর কেটে গেল।
বয়স হলো ৬৫ ।
চশমা ছাড়া চোখে
ভালো দেখেন না। সিঁড়ি ওঠা নামা করতে গেলে বুকে চাপ ধরে।
এর মধ্যে বড় ছেলে
দীনেন্দ্র নাথ আর বড় মেজো দুই বৌমাই গত হয়েছেন।
মেজ দেবেন্দ্র নাথ
বৃদ্ধ বয়সে ব্যবসা পাতি বিক্রী করে অবসর নিয়েছেন।
ছেলে মেয়েদের বিয়ে
দিয়েছেন। সংসার এখন নাত-বৌদের হাতে।
পরিবর্তন হয়েছে ছোটছেলে
নীতিনেরও। অভিনয় জগত থেকে রাজনীতির ময়দানে তার সফল পদক্ষেপ।
সে এখন একজন নাম করা মন্ত্রী, সারাক্ষণ মহাব্যস্ত।
তার দুই মেয়েরই বিয়ে
হয়ে গেছে। ছেলে শুভময়ও আর ছোটটি নেই।
কলেজ, খেলাধুলো, বন্ধু বান্ধব নিয়ে
সেও ব্যস্ত। তবু বাড়ির মধ্যে ওই ছেলেটাই দিনান্তে অন্তত একবার
নীহারের তিনতলার ঘরে একবার উঁকি দিয়ে যায়। বলে –
- “কি গো ঠাকুমা কেমন আছো? এখন কী বই পড়ছো? শরৎ চাটুজ্যে নাকি?”
এমনই এক দিনে ঠাকুমাকে দেখতে এসে শুভ আবিষ্কার
করলো যে নীহার বালা মারা গেছেন। সাড়া না পেয়ে কাছে
এসে দেখে যে নিশ্বাস পড়ছেনা, গা তখনও খুব ঠান্ডা হয়ে যায়নি।
সে চেঁচিয়ে বাড়ি
মাথায় করে ফেললো। মেজ কর্তা ছোট কর্তা এসে দেখে ডাক্তার ডাকলেন।
হার্ট ফেল।
ঘুমের মধ্যে শান্তিতে
চলে গেছেন। দুই ভাই পরামর্শ করে ঠিক করলেন চুপচাপ পেছনের দরজা
দিয়ে বডি বের করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে।
সে
কথা শুনে নাতি শুভময় আর এক প্রস্থ চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিল।
- “তোমরা মা বলে তাকে
মানো আর না মানো সে ছিল দাদুর বিবাহিতা স্ত্রী।
আমি সামনের দরজা
দিয়ে ঠাকুমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবো। তোমরা করো আর না
করো,
আমি ঠাকুমার মুখাগ্নি
করবো।”
মেজ
ছোট হার মানলেন। বিরক্ত হয়ে বললেন –
- “যা যা - তোর যা ইচ্ছে
কর গে যা।”
শুভময় সঙ্গে সঙ্গে
ফোন লাগিয়ে শ্মশানে যাবার জন্যে বন্ধু বান্ধব যোগাড় করে ফেললো আর একরাশ ফুল টুল আনিয়ে এক এলাহি কান্ডই বাঁধিয়ে ফেললো। অগত্যা,
নীতীন্দ্র নাথকে শ্মশানেও যেতে হোল আর মুখাগ্নিও করতে হোল।
পরদিন ইংরাজী বাংলা সব খবরের কাগজে বিখ্যাত মন্ত্রী
শ্রী নীতীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়ের মাতৃবিয়োগের খবর বড় বড় অক্ষরে ছাপা হোল।
যে মানুষটা তার জীবদ্দশায় ছেলেদের কাছ থেকে একদিনের
জন্যেও মা বলে স্বীকৃতি পায়নি সে মারা যাবার পর সারা দেশ তাকে কৃতি সন্তানের মা বলে
স্বীকৃতি দিলো।

1 comment:
heart breaking story. The way kulin girls have suffered in bengal is despicable! Its a crying shame! you are a great writer!
Post a Comment