পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর আগে কলকাতা শহর অন্যরকম
ছিল। এত গাড়ি, এত ভীড্, এত আওয়াজ ছিলনা।
আমাদের পাড়া থেকে
আমরা চারটি মেয়ে রোজ একসঙ্গে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম।
আমি, তুলি, কোয়েল আর মণিদীপা- আমাদের মণিদি।
আমি ক্লাস এইট, তুলি সেভেন, কোয়েল সিক্স আর মণিদি
ক্লাস টেন।
সবার প্রথমে তুলিদের বাড়ি।
ও দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোয়েল কে ডাকতো।
তারপর ওরা দুজন মণিদিকে
ডেকে নিয়ে আসতো আমাদের বাড়ি। তারপর আমরা চার বন্ধু
গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। মণিদি খুব সুন্দরী
আর প্রতি বছর পরীক্ষায় ফার্স্ট হোত, মাঝে মাঝে আমাদের অঙ্ক বুঝিয়ে দিত, তাই আমরা মণিদিকে
ভালো তো বাসতামই
- কিছুটা
সমীহও করতাম। তবে কোয়েল আর তুলির সঙ্গে আমার ইয়ার্কী ফাজলামীর সম্পর্ক
ছিল। বিকেল বেলা আমরা ফুটপাতে ব্যাডমিন্টন খেলতাম কিম্বা
কোয়েলদের কুকুর টমিকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটতাম।
লেখাপডায়
কোয়েল একটু কাঁচা,
শুধু ওরই প্রাইভেট
টিউটর ছিল। আমি আর মণিদি পাড়ায় দিবাকরদার কোচিং ক্লাসে যেতাম।
দিবাকরদা খুব বড়
লোকের ছেলে। বাবা মা মারা যাবার পর প্রচুর সম্পত্তির মালিক।
চাকরি টাকরি করেনা, প্রয়োজনও নেই।
বোধহয় সময় কাটানোর
জন্যে এক বন্ধুর সঙ্গে নিজের বাড়িতেই কোচিং ক্লাস খুলেছে।
খুব ভালো পড়ায়।
বছর দুয়েক হলো বিয়ে
করেছে,
বৌদি খুব সুন্দরী
তবে খুব লাজুক। আমরা কোচিং ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা বৌদির সঙ্গে আলাপ
করার খুব চেষ্টা করতাম, তবে বিশেষ সুবিধা হয়নি।
অঙ্ক, বিজ্ঞান ইত্যাদি
পড়াতেন দিবাকরদা আর বাঙলা ইংরাজী পড়াতেন ওঁর বন্ধু অশোকদা।
তখনকার দিনে এত competition ছিলনা, মণিদি ছাড়া আমাদের
কারোরই জীবনে বিরাট একটা কিছু হওয়ার উচ্চাশাও ছিলনা।
যাই
হোক যা বলছিলাম। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মণিদি আমাদের বললো -
“জানিস, আমার না বাড়িতে
বিয়ের কথা চলছে।”
আমরা তিনজনেই
সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম -
“সে কী মণিদি!”
মণিদি
বললো -
“এরা নাকি খুব বড়লোক, স্কুল থেকে ফেরার পথে গাড়ি করে যেতে যেতে আমাকে দেখেছে, তারপর পিছু পিছু এসে আমার বাড়ি দেখে গেছে।আমরাও ব্রাম্হণ জেনে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব।"
“তুমি বিয়ে করবে?”
“তোমার পড়াশোনা?”
“বিয়ে হয়ে গেলে স্কুলে
তো আর পড়তে দেবেনা, তবে ওরা বলেছে বাড়িতে
মাষ্টার রেখে পড়াবে।”
এবার আমি
ফোড়ন কাটলাম -
“ধুর - বিয়ের পর মেয়েদের
আর লেখাপড়া হয়না। আমার চিনু পিসি তো যেই বিয়ে হোল অমনি ইউনিভার্সিটি
যাওয়া ছেড়ে দিলো। বললো - বাবা: আর লেখাপড়া করতে হবেনা, বেঁচেছি।
এখন তো দুটো বাচ্চা
নিয়ে হিমশিম।”
মণিদি
খুব উদাস হয়ে বললো -
“না রে, আমার খুব পড়তে ভালোলাগে।
আমি কেমিষ্ট্রি নিয়ে
ডক্টরেট করবো,
বিদেশ যাবো - রিসার্চ করবো।
আমার অনেক স্বপ্ন।
দিবাকরদাও আমাকে
লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেয়।”
দেখলাম
মণিদির চোখের কোনে জল চিকচিক করছে, কথা বলতে গিয়ে ঠোঁট দুটোও কেঁপে উঠলো। আমরাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেলাম।
আমি, কোয়েল, তুলি, আমরা তিনজনেই মণিদিকে
খুব ভালোবাসতাম। তাই নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে একদিন ওদের বাড়ি মণিদিকে
মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমাদের আর্জি, যেন এত তাড়াতাড়ি
মণিদির বিয়ে না দেওয়া হয়।
মণিদির
মা তো আমাদের কথা শুনে হেসেই অস্থির! আর মণিদির
ঠাকুমা এসে চোখ রাঙিয়ে খুব কঠিন স্বরে বললেন-
“যা যা - সব বাড়ি যা - আর পাকামী করতে হবেনা।
ধিঙ্গি ডেঁপো মেয়ে
সব!
তোদের বয়সে আমাদের
কোলে কাঁখে দুচারটা করে…”
বাকিটা
শোনার জন্য আমরা আর দাঁড়াইনি - একছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম।
অপমানে চোখ ফেটে
জল এসে গিয়েছিল। তারপর থেকে মণিদির স্কুল যাওয়া বন্ধ হোল।
চারজনের বদলে আজকাল
আমরা শুধু তিনজন স্কুলে যাই, বিকেলে হাঁটাহাঁটি করি মণিদির বাড়ির সামনে দিয়েই, কিন্তু ওকে কোনদিনও
জানলা বা বারান্দায় দেখিনি। কোচিং ক্লাসও ছেড়ে
দিয়েছে। অমার মাও দুঃখ করে বলতেন-
“মণিটা লেখাপড়ায়
এত ভালো
- কেন
যে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে … আসলে ওর বাড়ির লোকেরা বড়লোক দেখে লোভে পড়ে গেছে।”
দিন
দশেক পর একদিন হঠাৎ মণিদির বাবা, উদভ্রান্তের মতো আমাদের বাড়ি এসে হাজির - মণিদি বাড়ি ছেড়ে
চলে গেছে। একটা চিঠি লিখে জানিয়ে গেছে - “ও বিয়ে করতে চায়না।
বাড়ি থেকে পালিয়ে
গেছে শুনে যখন পাত্র পক্ষ নিজেরাই বিয়ে ভেঙে দেবে, তখন ও বাড়ি ফিরে
আসবে। কেউ যেন চিন্তা না করে।”
আমরা
খুবই অবাক হয়ে গেলাম। মণিদি তো আমাদের
ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে দেয়নি, অবশ্য দেখাও হয়নি।
ওকে স্কুলে যেতে
দেওয়া হোতনা। বাড়িতে টেলিফোনও নেই যে ও ওর ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে
যোগাযোগ করে কারো বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকবে।
কোচিং ক্লাসের দিবাকরদার
বাড়িতেও খোঁজ করা হোল। দিবাকরদার স্ত্রী
বললেন - মণি সেখানেও নেই। মণিদির মায়ের অবস্থা
পাগলের মতো
- শেষ
অব্দি থানা পুলিশও হোল, অনেক খোঁজ খবর হোল, কিন্তু মণিদি আর ফিরে এলো না।
এরপর
প্রায় বছর দুয়েক কেটে গেছে। মণিদির স্মৃতি আমাদের
মনে আস্তে আস্তে আবছা হয়ে এসেছে। একদিন আমাদের স্কুলে
রেইনি-ডে হোল।
বৃষ্টি মাথায় করে
আমরা ক’জন মাত্র স্কুলে
পৌঁছে ছিলাম,
তাই ছুটি হয়ে গেলো।
হঠাৎ তুলি বললো -
“এই তোরা প্ল্যানচেট করবি?”
কোয়েল
আর আমি এক কথায় রাজি, কিন্তু কী করে প্ল্যানচেট করতে হয় জানিনা।
ভেবেচিন্তে আমার
পড়ার টেবিল থেকে বই পত্র সরিয়ে একটা সাদা কাগজ আর পেনসিল্ রাখলাম।
তখন তো প্রায় লোডশেডিং
হোত,
মোমবাতি ঘরেই ছিল।
আলো নিভিয়ে একটা
মোমবাতি জ্বেলে আমরা তিনজন হাত ধরাধরি করে বসে ভাবতে লাগলাম, এবার কাকে ডাকা যায়।
তুলির
জেঠিমা মাস তিনেক হোল মারা গেছেন, ওর suggestion হোল - জেঠিমা।
কিন্তু আমরা তাঁকে
চিনতাম না। আমি মনে মনে ভাবছি রবীন্দ্রনাথ - কিন্তু তিনি তো অনেক
দিন আগে মারা গেছেন, এতদূর থেকে কী আর আসতে পারবেন? কোয়েল জিগেস করলো
–
“আচ্ছা কুকুর বেড়ালের
আত্মাকে কী ডাকা যায়?”
আমরা বুঝলাম ও ওর কুকুর টমির কথা ভাবছে, যে বছর খানেক হোল
মারা গেছে।
আমি ওকে
দিলাম এক দাবড়ানি -
“হ্যাঁ আত্মা আছে।
কিন্তু টমি এলে সাদা
কাগজে কী লিখবে?
কী যে আছে তোর মাথায়!”
কোয়েল খুব অপ্রস্তুত হয়ে বললো -
“Sorry রে ..”
এরই
মধ্যে আমাদের হাতে ধরা পেন্সিলটা হঠাৎ কেমন নড়াচড়া করতে লাগলো।
কোয়েল ভয় পেয়ে হাত
সরিয়ে নিল,
তাই দেখে তুলিও।
কিন্তু আমি যেহেতু
ওদের থেকে বড়,
তাই ওদের সামনে সাহস
দেখাবার জন্যে পেন্সিলটা শক্ত করে ধরে রইলাম।
পেন্সিল লিখলে – "আমি এসেছি
তোদের কাছে
- মণিদীপা।"
মণিদীপা - মানে আমাদের মণিদি?
এবার
আমার ভয় পাওয়ার পালা। আমি প্রচন্ড
ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি পেন্সিলটা ছেড়ে উঠে ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম।
তিনটি কিশোরী কন্যা
একটা ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে, আঁধার হয়ে আসা আকাশ আর ঝোড়ো হাওয়ার দিনে ঐ লেখাটার
দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকলো।
এরপর
আর আড্ডা জমলোনা। বৃষ্টি একটু ধরতেই তুলি আর কোয়েল যে যার বাড়ি চলে
গেল। সারা সন্ধ্যে পডায় মন বসলোনা।
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের
দোলায় দুলতে দুলতে ভাবতে লাগলাম এ হতে পারেনা, নিশ্চয় আমার অবচেতন
মনের ভুল। মণিদিকে তো সত্যিই আমরা ভুলে যাইনি।
তাই হয়তো...
রাতে
খাওয়া দাওয়ার পর ঘরে এসে শুয়ে পড়েছি, হয়তো চোখে একটু ঘুমও এসেছে।
হঠাৎ মনে হোল কে
যেন আমাকে বলছে
- “আবার
পেন্সিলটা ধর,
আমার অনেক কথা বলার
আছে।”
মণিদির
কথা,
কিন্তু কোন শব্দ
নেই,
তবু আমি বেশ শুনতে
পাচ্ছি। আশ্চর্য, আমি এবার কেন জানিনা একটুও ভয় পেলামনা।
বৃষ্টি অনেকক্ষণ
থেমে গেছে। জানলা দিয়ে চাঁদের আলোর বন্যা।
সেই আলোয় পড়ার টেবিলে
কাগজ পেন্সিল নিয়ে বসে লিখে চললাম।
যা লিখলাম
বা মণিদি আমাকে দিয়ে যা লেখালে তার সারাংশ হোল এইরকম -
“আমি কোচিং ক্লাসের
দিবাকরদা আর অশোকদার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম।
ওরা বললো, যে ওরা আমাকে দিবাকরদার
বাগান বাড়িতে ক’দিন লুকিয়ে রাখবে, তারপর বিয়ে cancel হয়ে গেলে আবার ফিরিয়ে
আনবে। ওদের বিশ্বাস করে আমি ওদের সঙ্গে গিয়েছিলাম।
ওরা শরবতের সঙ্গে
ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে আমাকে নিস্তেজ করে দুজনেই সারা রাত ধরে আমার শরীর নিয়ে
খেলা করে,
তারপর গলা টিপে আমাকে
মেরে বাগানে একটা শিউলি গাছের নীচে কবর দেয়।
আমার কারো ওপর কোনও
রাগ নেই, শুধু আমার মা বাবা যেন আমার নামে গয়াতে পিন্ডদান করেন।”
হাতের
লেখা মুক্তোর মতো, আমার কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা নয়। লেখার সময় আমার মনে কোন ভয়
ছিলোনা। মণিদি তো আমায় কত ভালোবাসতো, সে কেন আমার ক্ষতি
করবে?
সে বেচারি শুধু নিজের
কথাটা বলতে এসেছিল।
পরদিন সকাল হতেই ঐ লেখাটা নিয়ে বাবার সঙ্গে মণিদিদের
বাড়ি গেলাম। হৈ হৈ কান্ড।
আবার অনেক থানা পুলিশ
হোল। প্রথমে দিবাকরদা বলেছিল যে ওর কোন বাগান বাড়ি নেই, কিন্তু ওর স্ত্রী
পুলিশকে বাগান বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেয়। বাগানে শিউলি গাছের
নীচে মাটি খুঁড়ে মণিদির দেহাবশেষ পাওয়া যায়।
দিবাকর
আর অশোকের জেল হোল। সবাই ভেবেছিল - ওরা এত বড়লোক, টাকার জোরে বড় উকিল
লাগিয়ে ঠিক ছাড়িয়ে আনবে, কিন্তু দিবাকরদার স্ত্রী সে সব কোন চেষ্টাই করেননি।

No comments:
Post a Comment