Thursday, July 23, 2020

মেনকার দুঃখ



এবার আমার উমা এলে বলবো সবই খোলাখুলি
মনের মাঝে এত দিনের জমিয়ে রাখা কথাগুলি ।

তোমার বাবা গিরিরাজের বয়স তো আর কম নয় !
Retire করে আয় কমেছে করলো খানিক নয় ছয়
টাকাকড়ি ভাইটি তোমার উড়নচণ্ডে মৈনাক
বলতে গেলে মহাভারত সেসব কথা না হয় থাক

মহেশ্বরের ছত্র-ছায়ায় তুমি মাগো আছো সুখে ;
অন্নপূর্ণা হয়ে তুমি অন্ন যোগাও সবার মুখে
Talented সব ছেলে মেয়ে, বড় বড় চার চারটি
বুড়ো বুড়ির খবর নিতে আসেওনা কেউ একবারটি
বাঙালিদের আবদারেতে সম্বৎসরে একটিবার -
বাপের বাড়ি visit কর  - week end দেখে দিন তিন চার

সঙ্গে আসে ছেলেমেয়ে, ওরাতো আর ছোটটি নেই -
বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেল, move out করার নামটি নেই
লোকের মুখে শুনি প্রায়ইলক্ষীর নাকি ভালো বিয়ে
শ্রী জনার্দন স্বামী তাহার সবই ভালো, তবে ইয়ে
কাজের মধ্যে বসে শুধু লক্ষী করেন পদসেবা,
এটা কেমন  Life style ! সেই কথাটা বলে কেবা !

গণপতি বাবাজীবন, health এর দিকে নজরই নেই
করে সবাই হাসাহাসি, ওই ভুঁড়ির দিকে তাকালেই
ফুল-বাবুটি কার্তিকেয় পা বাড়িয়ে আছেন যেন,
হলেই কোথাও মারামারি, উনি সদাই ready জেনো
"অন্য পাড়ার" মেয়েরা সব ওকেই নাকি পূজো করে?
মন্দ লোকের কাজ নেইকো মন্দ কথা বলে মরে

ওরই মধ্যে সরস্বতী- শান্তশিষ্ট নাতনী আমার,
দেবী তিনি লেখা পড়ার, শিল্প এবং সা রে গা মা র
ওসব এখন obsolete, চলছে লারেলাপ্পা গান -
লেখাপড়ার নাম নেইকো, six figure টি আগেই চান
 লক্ষী ছাড়া, আর কারো কদর নেইকো তেমন মর্ত ধামে
দুর্গা পূজো করছে বটে, কেবল ফুর্তি করার নামে ।

আগে আগে সারা বছর কাটতো শুধু আশা নিয়ে –
উমা আমার আসবে ঘরে সোনার নূপুর পায়ে দিয়ে ।
ঝলমলিয়ে ঊঠবে হেসে গিরিরাজের আঁধার গেহ
চারটি দিনের তরে ও মা । দুখিনি এই মায়ের স্নেহ
দিতাম তোমায় উজাড় করে। সেদিন এখন বহু দূরে
তুমিও মাগো পালটে গেছো, আমরা বাজি বেসুর সুরে ।

বাড়লো যেমন family তোমার, আমরা দুজন হলাম বুড়ো –
অত জনের বাসমতী চাল, পাঁঠার মাংস, মাছের মুড়ো
কোথায় যে পাই! এখন যে তাই মহালয়ার পরে পরেই -
আমার বুকে palpetition, গিরিরাজ তো পড়েন জ্বরেই ।

বলবো আমি আমার কথা – দুঃখ তুমি পাও বা না পাও –
সবার মেয়ে মাকে দেখে, তুমি তো মা ফিরেও না চাও ।
বলবো এসব গৌরী মাকে, আমার মনের যত কথা –
মেয়ে আমার বুঝবে না কি মা মেনকার মনের ব্যথা? 







রণছোড়জী


মহাভারতের কৃষ্ণ এবং রণছোড়জী

ছোট বেলায় বড়দের কাছে যখন পুরাণের গল্প শুনতাম, তখন তা গল্প শুনতে ভাল লাগতো বলেই শুনতাম। তার সঙ্গে আমাদের হিন্দু ধর্মের কি যোগাযোগ তা ভাববার বয়স হয়নি। বড় হয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়ে এবং অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝলাম রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের গল্প শুধু গল্প নয় তা আমাদের ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

     আজ যা লিখতে চলেছি তা সবই হয়তো আপনাদের জানা, তাও পুরনো কথা আমার মত করেই বলি। মহাভারতের লেখক বলেছেন নর এবং নারায়ণ নামে দুজন ঋষি পরজন্মে অর্জুন এবং কৃষ্ণ হয়ে জন্মেছেন এই নারায়ণ ঋষি ছিলেন – বৈকুন্ঠবাসী নারায়ণ বিষ্ণু নন মহাভারতে দুএকটি জায়গা ছেড়ে দিলে কৃষ্ণকে পুরুষোত্তম পরমজ্ঞানী মানুষ বলেই মনে হয় মহাভারতে কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত নেই, তাঁর সাংঘাতিক কোন অলৌকিক ক্ষমতারও বর্ণনা নেই তবে নিজের সারাজীবনের উপলব্ধি ও দর্শনকে তিনি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যে রেখে গেছেন- তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্ত্তি গীতায় মানুষের মতো তিনি শোক দুঃখ পেয়েছেন, দেহত্যাগও করেছেন সাধারণ মানুষের মতোই উদাহরণ হিসাবে মহাভারত থেকে কৃষ্ণের জীবনের দুএকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাক

     মহাভারতের কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে মথুরা অধিকার করেন আবার সাধারন মানুষের মতো জরাসন্ধের ভয়ে (জরাসন্ধ একজন প্রবল পরাক্রমশালী রাজা এবং সম্পর্কে কংসের শ্বশুর ছিলেন) মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় গিয়ে রাজত্ব স্হাপনা করেন পরবর্তী কালে তিনি ভীমের সাহায্যে জরাসন্ধকে হত্যা করিয়ে পুরোন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেন জরাসন্ধের ভয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যান যে মানুষ কৃষ্ণ তিনিও পূজিত হন দ্বারকায় “রণছোড়জী”র মন্দিরে আজকের লেখা সেই মানুষ কৃষ্ণ রণছোড়জীকে নিয়ে তবে তার জন্য একটু পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা যাক

     দ্বাপর যুগে মথুরা ছিল রাজা উগ্রসেনের অধিকারে উগ্রসেন তাঁর দুই কন্যা রোহিনী ও দেবকীর বিবাহ দিয়েছিলেন সুদেবের সঙ্গে কংস উগ্রসেনের ক্ষেত্রজ পুত্র দেবকীর বিবাহের সময় দৈববানী হয়েছিল যে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কংসের বিনাশের কারণ হবে কংস তাঁর শ্বশুর মহাপরাক্রমশালী রাজা জরাসন্ধের সাহায্যে সুদেব ও দেবকীকে কারারূদ্ধ করে নিজে মথুরার সিংহাসনে বসেন অলৌকিক উপায়ে দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান বলরাম রোহিনীর কাছে পৌঁছে যান (বলরাম অবশ্য রোহিনীর পুত্র বলেই পরিচিত) দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণকে বসুদেব গভীর দুর্যোগের রাত্রে গোকুলে নন্দের আশ্রয়ে পৌঁছে দেন কংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য রোহিনীও বলরামকে নন্দের গৃহে পৌঁছে দিয়েছিলেন

     কৃষ্ণ ও বলরাম দুই ভাই বড় হয়ে তাঁদের মামা কংসের নৃশংসতার কথা জানতে পারলেন – কংসও জানতে পারলেন এঁদের কথা কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করবার নানা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে কংস তাঁদের ধনুর্যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করে হত্যা করবার পরিকল্পনা করলেন কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হল, কৃষ্ণর হাতে তিনি নিজেই নিহত হলেন

     কংসকে হত্যা করবার পর কৃষ্ণ মথুরার রাজা হলেন এদিকে জরাসন্ধ কৃষ্ণের বিরূদ্ধে তাঁর জামাতাকে হত্যা করবার অপরাধে প্রতিহিংসা নেবার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন এবং বারবার মথুরা আক্রমণ করতে লাগলেন আঠারো বার ব্যর্থ হওয়ার পর জরাসন্ধ কালযবন নামে একজন মহাশক্তিশালী রাজার সাহায্য নিয়ে মথুরা আক্রমণ করতে এগোলেন

     এইখানে কালযবনের কথা একটু বলা দরকার কালযবনের পিতা গার্গ্য তপস্যা করে মহাদেবের কাছে বর পেয়েছিলেন যে তাঁর পুত্র কালযবন অজেয় হবে কৃষ্ণ জানতেন সেকথা তাই কৃষ্ণ যখন সংবাদ পেলেন যে জরাসন্ধ এবার আর একা নন, কালযবন আসছেন তাঁর সঙ্গে মথুরা আক্রমণ করতে তখন তিনি রণে ভঙ্গ দিয়ে মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় চলে যাওয়াই সুবিবেচনা মনে করলেন । যুদ্ধ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে শ্রীকৃষ্ণের নাম হোল রণছোড়জী ।

             এখন কৃষ্ণ স্বয়ং মহাদেবের বরে অজেয় কালযবনকে কৌশলে কেমন করে বিনাশ করলেন সেকথা বলি মান্ধাতার পুত্র মুচকুন্দ এক অদ্ভূত বর লাভ করেছিলেন মুচকুন্দ নিদ্রিত থাকার কালে কেউ যদি তাঁর নিদ্রাভঙ্গ করে, চোখ মেলে তিনি প্রথম যার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন সে অভাগা মুচকুন্দের চোখ থেকে নির্গত ক্রোধবহ্নিতে সঙ্গেসঙ্গে ভষ্মীভূত হবে কৃষ্ণ সে খবরও রাখতেন দেবাসুরের যুদ্ধে জয়লাভের পর শ্রান্তিতে অবসন্ন মুচকুন্দ একটি গুহার মধ্যে নিদ্রাবিভূত হলেন কালযবনকে যুদ্ধে উত্তেজিত করে কৃষ্ণ মুচকুন্দ যে গুহায় ঘুমোচ্ছিলেন সেই গুহায় ঢুকে পড়ে মুচকুন্দের পিছন দিকে চুপিচুপি লুকিয়ে রইলেন কালযবন হুঙ্কার দিয়ে সেই গুহায় প্রবেশ করলে মুচকুন্দ ঘুম ভেঙ্গে তাঁর দিকে প্রথম দৃষ্টিপাত করলেন এবং বলাই বাহুল্য কালযবন ভষ্মীভূত লেন

      এবার আসা যাক জরাসন্ধ-বিনাশের কথায় জরাসন্ধ নরমেধ যজ্ঞে মহাদবের কাছে বলি দেবেন বলে অনেক ক্ষত্রীয় রাজাকে বন্দী করে রেখেছিলেন মদগর্ব্বী অহঙ্কারী রাজা জরাসন্ধকে বিনাশ এই সব কারণে প্রয়োজন ছিল । সৈন্যসামন্ত নিয়ে যুদ্ধ করলে জরাসন্ধকে পরাস্ত করা সম্ভব নয় জেনে ভীম এবং অর্জুনকে নিয়ে কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অদ্বার দিয়ে মগধে প্রবেশ করলেন । ভীমকে জরাসন্ধের শরীরে কোন জায়গায় দূর্বলতা আছে তা জানিয়ে দিলেন এবং ভীম সমুখ-সমরে জরাসন্ধকে হত্যা করলেন ।

      শঙ্করাচার্য্য তাঁর দশাবতারে রাম এবং বলরামকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবে স্বীকার করেছেন কৃষ্ণকে নয় । অথচ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে কৃষ্ণের নামে মন্দির এবং তীর্থক্ষেত্র রামের চেয়েও অনেক বেশী। কৃষ্ণকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে দেখি বহুপঠিত অন্যতম ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতে । হয়তো এরই প্রভাব হিসাবে কৃষ্ণকে বেশীরভাগ হিন্দুরাই বিষ্ণুর অবতার বলে মানে । কৃষ্ণের শিশু বা বালক রূপ, বালগোপাল রূপে – তাঁর যৌবনের রূ, বংশীধারী রূপে, তারপর তাঁর বিষ্ণুরূপ- শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী নারায়ণ রূপে পূজিত হয় । বৃন্দাবনের মন্দিরগুলিতে কৃষ্ণ যেন মানুষ, তাই তাঁর মূর্তি দ্বিভুজ । আবার অনেক মন্দিরে কৃষ্ণের মূর্তি বৈকুণ্ঠবাসী বিষ্ণুর মতো চতুর্ভুজ । দ্বারকার রণছোড়জীর মন্দিরে কৃষ্ণের কালো ষ্টিপাথরে তৈরী মূর্তিটিও চতুর্ভুজ । তার মানে যদিও আমরা জানি যে আমাদের ভগবান কোন অলৌকিক ক্ষমতা না দেখিয়ে মানুষের মতোই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করেছিলেন তবু সেই ঘটনাকেও চিরস্মরণীয় করে রেখে আমরা তাঁকে রণছোড়জীর মন্দিরে বিষ্ণুরূপে চতুর্ভুজ মূর্তিতে পূজো করি ।

      কৃষ্ণের প্রথম জীবন মথুরায় কাটলেও শেষ জীবন কেটেছে দ্বারকায় । দ্বারকা পবিত্র স্থান । এখানে গোমতী গঙ্গা সমুদ্রে এসে মিলিত হয়েছেন । গোমতীর তীরে দ্বারকার প্রাচীন শহরে আছে রণছোড়জী কৃষ্ণের বিখ্যাত মন্দিরটি । ছাপ্পান্নটি সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলে মন্দিরের স্বর্গদ্বার । শহরের দিকে মন্দিরের সিংহদ্বারের নাম মোক্ষদ্বার । এই মন্দিরের মত এত ভারী ভারী রূপার দরজা খুব কম মন্দিরেই আছে । মন্দিরের প্রাঙ্গনে কৃষ্ণের আত্মীয়বর্গের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধার মন্দিরও আছে । আর আছে মন্দিরের সংলগ্ন ক্ষেত্রে শঙ্করাচার্য্য স্থাপিত সারদা মঠ

     রণছোড়জীর কথা বলতে রাণী মীরাবাঈ এর কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । রাজস্থানে কৃষ্ণপ্রেম প্রচার করেন মীরাবাঈ তাঁর অপূর্ব মাধুর্যপূর্ণ ভজনের মাধ্যমে । মেবারের রাণী মীরা কেন মেবার পরিত্যাগ করে দ্বারকায় এসেছিলেন তা জানিনা তবে কিম্বদন্তী আছে যে এই মন্দিরেই তিনি বিগ্রহের মধ্যে বিলীন হয়ে যান যেখানে কেটেছিল তাঁর জীবনের শেষ কটি দিন । মীরাবাঈ মেবার পরিত্যাগ করবার পর মেবার রাজ্যে নানান দুর্লক্ষণ দেখা দিলে প্রজারা ভয় পেয়ে মনে ভাবলেন যে তাদের পরম ভক্তিমতী রাণী মীরা তাদের ছেড়ে চলে যাওয়াই এই সব দুর্ভোগের কারণ । তারা রাণার কাছে তাদের প্রিয় রাণীকে ফিরিয়ে আনার জন্যে দরবার করতে লাগলো । রাণা তখন কজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে পাঠালেন দ্বারকায় মীরাকে মেবারে ফিরিয়ে আনার জন্যে । মীরা ব্রাহ্মণদের বললেন যে তিনি ফিরে যাবেন তবে তার আগে তাঁকে রণছোড়জীর অনুমতি নিতে হবে । মন্দিরের ভিতরে ঢুকে তিনি দ্বার রূদ্ধ করলেন । অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবাই মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন মীরাবাঈ কোথাও নেই শুধু তাঁর পরিধেয় বস্ত্রটি লেগে আছে বিগ্রহের গায়ে । অপার অনুগ্রহে ভগবান নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন তাঁর পরম ভক্তকে ।

কৃষ্ণ অবতার কি না, তাঁর চতুর্ভুজ মূর্তি কেন হলো, মীরাবাঈএর কথা শুধু গল্পকথা কি না, এসব যুক্তি তর্ক মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাসের কাছে হার মেনেছে

 

          অনেক স্থানীয় লোকের ধারণা যে দ্বারকার মন্দিরে যে বিগ্রহটি আছে সেটি আসল নয়। আদি রণছোড়জীর মূর্তিটি আছে ডাকোরে। তবে সে আরেক কাহিনী। যদি আজকের এই লেখা পড়ে আপনাদের ভালো লাগে তবে আমাকে জানাবেন (suparnam@hotmail.com) সে গল্পও আরেকদিন বলবো ।   



 

বাবুয়া



দুই হাতে দুই ছোট্ট গাড়ী, দুপদুপিয়ে যায়
বাবুয়া বলে ডাকলে পরে এদিক ওদিক চায় ।
চাঁদের আলোয় মাখন দিয়ে, হাত পা গুলো গড়া –
প্রথম দেখেই নতুন করে আবার প্রেমে পড়া।
তোমার চলা ছুট্টে চলা- আমার বসে থাকা;
আমার ওড়া শ্রান্ত এখন, তোমার নবীন পাখা
তোমার মুখর কলগীতি কোন অসীমের দান –


ফিরিয়ে আনে আমার প্রানে হারিয়ে যাওয়া গান ।।

ধূসর জীবন অন্তহীন -আঁধার ছিল ঘিরে

 তোমার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় আলোয় এলো ফিরে

  



আকাশ পারের সখা

  

    মাঝে মাঝে আমি তাকে  ডাক  দিই
    কেউ তাকে চেনেনা 
    সে আমার অধরা প্রেমিক -
    আমার আকাশ পারের সখা
    ধরা পড়ার ধরা দেবার ব্যাপার নেই
    নেই কোন আশ্লেষ চুম্বন 
    বা গুরুতর কোন আদরের দাবী 
    প্রায়শঃই  যার পরিণতি শুধু ক্লান্তিতে। 

    ডাক পাঠালেই সে আসে 
    কোন সুদূর নীহারিকার পথ বেয়ে
    অনন্ত আকাশের ওপার হতে। 
    আমরা হাতে হাত রেখে 
    পাশাপাশি বসি
    কখনো চুপটি  করে 
    কখনো বা অবিশ্রাম কথার মালা গাঁথা চলে। 

    আজ আকাশে ঘনঘটা 
    সেই মেঘের কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে আমার দুচোখে 
    বুকের কোথাও একটা ঝরঝর বৃষ্টির ঝর্ণা 
    এই এক অকারণ মন খারাপের অসুখ 
    তার সঙ্গে বাঁ  দিকে একটা চিনচিন ব্যথা 
    থেকে থেকে জানান দেয় 
    তোমার সময় যে শেষ হয়ে এলো। 

    আজ আমার মনটা তেমন ভালো নেই 
    আমার এই সাঁঝ বেলাতে 
    তাই ডাক পাঠিয়েছি তাকে। 

    ওগো আমার আকাশ পারের সখা -
    আজ আর নয় কোন কথা 
    নয় কোন অভিযোগ অনুযোগ
    আজ এসো 
    শুধু আমার মাথায় তোমার হাতখানি রেখে বলো। 
    "তোমার কি হয়েছে সোনা ?"

    অমনি একরাশ ফুলের পাপড়ি 
    ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে এসে আমার আঁচল ভরে দেবে। 
    আর সেই চিনচিন ব্যথা ভরা বুকে -
    উঠবে একটা অবাক করা খুশীর তুফান 
    কোন উত্তর দেব নাতো  -
    শুধু তোমার হাত ধরে 
    আমি চলে যাবো সেই এক্কেবারে -
    না-ফেরার দেশে।


          









    

Saturday, July 11, 2020

মনের মানুষ



          

সোনার শিকল ভাল্লাগেনা
শিকল কেটেছি ;
উড়ে এসে তোমার ডালে
একটু বসছি ।

মিষ্টি হাসি, নরম  ছোঁওয়া -
শীতের দুপুর বেলা -
মধুর ভাবের আনাগোনা
শুধু কথার খেলা ।

দূরের ডালে আরেক পাখি -
একটু উড়ে যাই ?
উষ্ণ নরম মিষ্টি ছোঁওয়া
একটু যদি পাই !

না না না - কোথায় যাবে কেন যাবে -
আমার ডালেই থাকো ।
মুগুর দিয়ে মারবো মাথায়
কোথাও চেয়ো নাকো ।

সোনার শিকল ছিলো ভালো -
এ যে লোহার শিকল !
মধুর ভাবের বড়ই অভাব -
মেজাজ খানা বিকল ।

মনের মানুষ কখন যেন
হোল বনের মানুষ -
দাঁত দেখা যায়, নখ দেখা যায়,
হাওয়ায় ওড়ে ফানুষ,
আমার বড় সাধের ফানুষ ।।




Friday, July 10, 2020

Rajasthan Stories (4) - পরমেশ্বরী





            সোমনাথ আর কাজল গরম কালে ছাদের ঘর ছেড়ে একতলার একটা ঘরে জিনিষ পত্র নিয়ে নেমে এলো ওপরে এত গরম যে টেঁকা যায়না ইলেকট্রিসিটি নেই, কাজেই ফ্যান বা এ সি র প্রশ্ন নেই নীচের ঘরের সামনে ঢাকা বারান্দা, তাতে গরমটা একটু কম লাগে তার ওপর দরজা জানলায় খসখস বলে একরকম ঘাসের মোটা পর্দা টাঙানো, তাতে মঙ্গল অহরহ বালতি করে জল এনে ছিটিয়ে দেয় সেই খসখসের পর্দার মধ্যে দিয়ে যে হাওয়া আসে তা মোটামুটি ঠান্ডা আর একটা সুন্দর গন্ধ আছে
            কাজল একটা ব্যাটারীর ট্রানসিসটর আনিয়েছে জয়পুর থেকে রোজ দুপুরে সেটা চালিয়ে শুয়ে থাকে বেশীর ভাগ দিন সোমনাথও খানিকটা লম্বা বিশ্রাম নেয়, তারপর রোদ পড়লে হাসপাতালে চলে যায়  তবে তেমন রোগী চলে এলে কেউ না কেউ এসে ডেকে নিয়ে যায়
            কুকুরগুলো লম্বা জিভ বের করে হা হা করে হাঁপায় ছাগল চরানো ছোট ছেলেরা ছাগল গুলোকে বড় গাছের ছায়ায় বসিয়ে রাখে এই ছেলেগুলোর পরনে কাপড় না জুটলেও মাথায় কিছু একটা পাগড়ীর মতো করে বাঁধা আর পায়ে জুতো থাকবেই থাকবে বালি গরমে এতো তেতে থাকে যে খালি পায়ে বেরোলে পায়ে নির্ঘাত ফোস্কা পড়বে
            জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে যত দূর চোখ যায় শুধু ধু ধু বালি আর বালি কখনো হঠাৎ একটা ঘূর্ণী হাওয়া এসে খানিকটা বালি গোল করে ঘুরিয়ে ওপরে তুলে দেয় তারপর আবার সব চুপচাপ দু সেকেন্ড আগেও যে এখানে তান্ডব হয়ে গেছে তার চিহ্ন মাত্র নেই যাদের জন্ম কর্ম কলকাতায়, তারা প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ কল্পনাও করতে পারবেনা
            রোগীরা হাসপাতালে আসে উটের গাড়ি করে এত গরম ঘোড়াও সহ্য করতে পারেনা কখনো কখনো জোর বালির ঝড় ওঠে - আঁধি গরম হাওয়া বালুলেগে হিট স্ট্রোকে লোক মরে রোগী আসতে না পারলে তখন ডাক্তারকে ওরা ঐ রকম উটের গাড়ি করে নিয়ে যায় সোমনাথের ফর্সা রঙ এখন রোদে পুড়ে বেশ তামাটে
            কিষণলাল কেডিয়া বলে দিয়েছেন, সবাই কিছু গরীব মানুষ নয়, বিনা পয়সায় চিকিৎসা হচ্ছে, যদি নিজে থেকে কেউ কিছু দিতে চায় নিশ্চয় নেবেন সেই পাওনাটা অনেক সময় অযাচিত ভাবে আসে, রোগী সেরে ওঠার পর কখনো আসে মুর্গী, কখনো এক ঝুড়ি আম, মোষের দুধ থেকে তৈরী ঘি - বা এক বস্তা গমের আটা যার যেমন ক্ষমতা একবার এসেছিল কাঁচা লঙ্কা, তেঁতুল আর গুড় দিয়ে তৈরী মিষ্টি আচার কোথা থেকে শুনেছে বাঙালীরা সবেতে মিষ্টি দিয়ে খায়
            মাঝে মাঝে বাড়িতে এত আম এসে যায় যে সবাই মিলে খেয়ে শেষ করা যায়না তখন সিমাকোরি একটা পাতলা কাপড়ে ছেঁকে আমের রস বের করে আর তার সঙ্গে ঘন দুধ মিশিয়ে ওদের খেতে দেয় রুটি বা পরোটার সঙ্গে এই বস্তুটিকে ওরা বলে আমরস্ সোমনাথের শখ - রুটি নয় পরোটা - তেলে নয়, বলে এখানকার ঘি এত সস্তা - ঘি দিয়ে বানাও আর রোজ রাত্রে শেষ পাতে খানিকটা ক্ষীর বলে -

-         বুঝলে কাজল,  চাকরির জন্যে এই অজ গাঁয়ে পড়ে আছি, একটু ভালো মন্দ না খেলে হয় কখনো ?

            মাঝে একবার সোমনাথকে বিশেষ কোন ওষুধ পত্র আনতে জয়পুর যেতে হয়েছিলো ফেরার সময় টিনের বাক্সে বরফ দিয়ে মাছ নিয়ে এসেছিলো কতদিন পরে মাছ! কাজলের সে কী আনন্দ! ওর সেই পরম উৎসাহে কোমরে আঁচল জড়িয়ে মাছ রান্না করা দেখে সোমনাথের মনটা মায়ায় ভরে যায় কলকাতার বাঙালী - তার ওপর এই মেয়ের মাছ না হলে ভাত খেয়ে পেট ভরতোনা এখন কেমন মানিয়ে নিয়েছে, একদিনের জন্যেও কোন ব্যপারে অভিযোগ নেই
            সিমাকোরি রান্না ঘরে মাটির উনুনে কাঠ জ্বেলে রুটি বানায়, কাজল সামনে ঢাকা বারান্দায় মোড়া পেতে বসে ওর সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করে আর কার সঙ্গেই বা কথা বলবে? মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে মার চিঠি আসে, সে চিঠি পড়ার সময় বুকের মধ্যে চিন চিন করে আর উত্তর লিখতে গিয়ে চিঠির কাগজ চোখের জলে ভিজে যায়
            গরম কালে সূর্য ডুবতে দেরী হয় বলে দিনটা বেজায় লম্বা মনে হয় আজ প্রায় এক বছর হল পরমেশ্বরী শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে পাঁচ ছটা গ্রামের পর অন্য একটা গ্রামে তার শ্বশুর বাড়ি বর মিলিটারীতে সিপাই তাই নিয়ে পরমেশ্বরীর বাপ মঙ্গলের খুব গর্ব অবশ্য মেয়ের বিয়েতে সে মোটা টাকা যৌতুকও পেয়েছে হ্যাঁ, ওদের জাতে মেয়ের বাবা ছেলের পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয় মেয়ে ওদের কাছে asset. যে সংসারে যাবে তাদেরই তো সুসার মেয়েটা বড় হাসিখুশী ছিল সব কথায় তার হি হি করে হাসা চাই কাজলের ওর কথাও খুব মনে পড়ে দুপুর হলেই সে কাজলের কাছে সেলাই শেখার নাম করে চলে আসতো আর নানা রকম মজার মজার গল্প শোনাতো
            মঙ্গলের সামান্য অক্ষর পরিচয় আছে, এছাড়া আর কারোরই লেখাপড়ার বালাই নেই, তাই চিঠি পত্রে খোঁজ খবর নেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা তাও পরমেশ্বরীর শ্বশুর বাড়ির গ্রাম থেকে কেউ এসেছে শুনলে মঙ্গল সব কাজ ফেলে তার কাছে দৌড়য়, মেয়ের খবর নেবার জন্যে
            পরমেশ্বরীর শ্বশুর বাড়ির গ্রাম থেকে একজন লোক একদিন মালসিসরে এলো বাড়ি অব্দি আর আসতে হয়নি - মঙ্গলের সঙ্গে তার বাজারেই দেখা হয়ে গেছে খবর খুবই খারাপ পরমেশ্বরীর বর মারা গেছে না, যুদ্ধে নয় - রোড অ্যাকসিডেন্টে চোখের জল মুছতে মুছতে মঙ্গল বাড়ি এসে সিমাকোরিকে খবরটা দিল জামাইএর মৃত্যু সংবাদে ওরা দুজন একটু কান্না কাটি করলো ঠিকই কিন্তু চট করে সামলেও উঠলো
পরদিন রান্না করতে করতে সিমাকোরি কাজলকে জানালো -
-         ক্যয়া কঁরে মায়জী, ভাগ মেঁ জো লিখ্যো হ্যয় সো তো হোগো ই পরমেশ্বরীকে বাপু পরমেশ্বরীকো অ্যঠে লেকে আ যাওয়েগো ছোরি তো অব ভি জওয়ান হ্যয়

            কাজল ভাবে সত্যিই তো, বিধবা হয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকেই বা কি হবে আবার অপয়া টপয়া বলে অত্যাচার না করে! মঙ্গল গেল মেয়েকে আনতে, কিন্তু শুকনো মুখ করে ফিরে এলো ওরা মেয়েকে ছাড়েনি
            কিছুদিনের মধ্যেই পুরো ব্যপারটা বোঝা গেলো বিয়ের সময় ওরা তো মঙ্গলকে অনেক টাকা যৌতুক দিয়েছে - তার কি হবে এদিকে মঙ্গল মনে মনে ভেবে রেখেছিল পরমেশ্বরীকে নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখবে, তার পর কিছু দিন গেলে আস্তে ধীরে পাত্র দেখে আবার তার বিয়ে দেবে বলাই বাহুল্য, আবার পাত্র পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে
           
            কিন্তু পরমেশ্বরীর শ্বশুর বলেছে সব টাকা ফেরত দিয়ে তবে মেয়ে নিয়ে যাও সে টাকা মঙ্গলের আছে নাকি! সে মেয়েদের জন্যে নতুন ঘাগরা করিয়েছে, রূপোর গয়না গড়িয়েছে, নিজের কুঁড়েঘরটি মেরামত করিয়েছে, জামাইএর স্যুট, ঘড়ি আর বাকিটা গেছে কিছু লোকজন খাওয়ানোতে টাকা ফেরত দাও বললেই অমন ফেরত দেওয়া যায় নাকি?
          রাতের বেলা ছোটরা ঘুমিয়ে পড়লে মঙ্গল সিমাকোরির সঙ্গে পরামর্শ করে, কিন্তু কোন পথের সন্ধান পাওয়া যায় না
            খবরাখবর করে যা জানা গেল তা হল এই যে, পরমেশ্বরীর শ্বশুর ওকে জোর জার করছে ওর দেওরকে বিয়ে করতে যে দেওর নাকি ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট
            মাস খানেক পর এক ভোর রাতে পরমেশ্বরী শ্বশুর বাড়ি থেকে হঠাৎ এসে হাজির পালিয়ে এসেছে
কথায় কথায় জানা গেল, খবর সত্যি ওর ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল দেওরকে বিয়ে করার জন্য
সে কথা কাজলকে বলতে গিয়েও পরমেশ্বরী হেসে অস্থির, বলে -
-         মাজী, ম্যঁয় বলুঁ - অরে উয় তো একদম সে বচ্চো হ্যয় মাহনে সাদী কে লিয়ে মত্ বোলো, ম্যঁয় অঠেই থারো পাস রহ যাউঁঙ্গী থে ফিকর না করো তো উয় সুনে কোনি
ওপাশ থেকে সিমাকোরি ফোড়ন কাটে -
-         তেরো বাপ্পু নে পয়সো লিও ...
পরমেশ্বরীর সেই খিলখিল্ হাসি বলে-
-         তো কল্ শাম কো ঘর মাঁ জব ম্যঁয় একেলি থি, তো উয় সুসরা মাহরো কমরোমাঁ ঘুস আয়ো অউর জবরদস্তি করনে লগো থো তো ম্যঁয়নে মাজী উনহে ইতনো জোরেসে ধক্কো মারো তো উয় একদম সে জমিন পর পটক গয়ো একদম্ অ্যায়সে !
আবার সেই হাসি
-         তো ম্যঁয়নে মাজী তব ভি জোরসে ভাগী, অউর একদমসে বাস পকড় লিও
            কাজল অবাক হয়ে পরমেশ্বরীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে এ মেয়েটির নিজস্ব জগতে চোখের জল, হা হুতাস বা ভাগ্যকে দোষারোপ করার কোন স্থান নেই উনিশ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়েছে, শ্বশুর একা পেয়ে শ্লীলতাহানি করতে গেছে, এক বস্ত্রে টাকা পয়সা গয়না গাটি সব ছেড়ে খালি হাতে পালিয়ে এসেছে, তাও ওর মুখের হাসি কেউ কেড়ে নিতে পারেনি