Tuesday, October 20, 2020

রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী

 

 

রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী




 

    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর জন্ম  ১৮২৬ সালে। ১৮৩৪ সনে বিয়ের সময় তাঁর বয়েস ছিল আট (মতান্তরে ছয়) আর দেবেন্দ্রনাথের বয়স সতের। দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথের বউ আনলেন যশোরের দক্ষিণডিহি থেকে তাঁর বিয়ের আগের নাম ছিল শাকম্ভরী। শ্বশুর দ্বারকানাথ ঠাকুর আর শ্বাশুড়ি দিগম্বরী দেবী। ভরা সংসার। দিগম্বরী দেবী অত্যন্ত ধর্ম-প্রাণা মহিলা ছিলেন। ভোর চারটে থেকে শুরু হত তাঁর পুজো। স্বপাক আহার, নিরম্বু উপবাস, জপ তপ আর ধর্ম গ্রন্থ পাঠ।

    বালিকা সারদা এই পরিবেশে বড় হতে লাগলেন দেবেন্দ্রনাথের পরের ভাই গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া এবং সারদা দুজনেই কিছুকিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন মাইনে করা বৈষ্ণবী এসে "শিশুবোধক", "রামায়ণ", "মহাভারত", "চাণক্যশ্লোক" ইত্যাদি পড়াতো তার সঙ্গে কলাপাতায় চিঠি লেখা শেখাও চলতো সারদা অবসর পেলেই একটা না একটা বই নিয়ে বসতেন চাণক্যশ্লোক ছিল তাঁর প্রিয় গ্রন্থ মালিনী বটতলা থেকে ছাপা বই এর পসরা নিয়ে আসতোতার থেকে বাড়ির মেয়েরা বেছে বেছে বই কিনতেন

    শ্বাশুড়ি দিগম্বরী দেবীর ধর্মানুরাগের প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল দুই পুত্রবধূ সারদা আর যোগমায়ার পরে তবে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে এই দুজনের জীবন ধারা বয়ে গিয়েছিল দুই ভিন্ন ধারায়।

    ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি সারদা দেবীর তেমন কোন আকর্ষণ না থাকলেও তিনি সরলহৃদয়া পতিব্রতা স্ত্রীর মতো মহর্ষি স্বামীর উপযুক্ত সহধর্মিণী হওয়ারই চেষ্টা করেছেন। তবে এইখানে একটা কথা বলা দরকার। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতা বিসর্জন দিয়ে একেশ্বর বাদকে অন্তরে ধারণ করে ব্রাহ্ম ধর্মে নিজেকে দীক্ষিত করলেও তিনি বিশেষ ভাবে প্রগতিশীল ছিলেন বলে মনে হয়না। কারণ হিন্দু ধর্মের অনেক সংস্কার তিনি ব্রাহ্ম হয়েও আজীবন পালন করেছেন। যেমন বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা কোনটাই তিনি সমর্থন করতেন না। পারিবারিক প্রথা বা অন্দর মহলের আচার নিয়েও মাথা ঘামান নি। সে সময় ঠাকুর বাড়িতে পর্দা প্রথা বেশ ভালো রকমই চালু ছিল। তাই সারদা দেবীর জীবন যাত্রায় এক বিগ্রহ পুজো ছাড়া আর বিশেষ কোন পরিবর্তন আনতে হয়নি।

    সারদা দেবীর বারো বছর বয়সে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন – সেটি বাঁচেনি। এর পরে আগামী পঁচিশ বৎসরের মধ্যে সারদা দেবী পনেরোটি পুত্র কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান কখনো দু বৎসর কখনো বা তারও কম শুধু নবম এবং দশম সন্তানের মধ্যে বয়সের ব্যবধান চার বৎসর শেষ দিকে ছটি সন্তানের জন্ম হয়েছে আট বৎসরের মধ্যে শেষ সন্তান বুধেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৩ সালে, তখন সারদা দেবীর বয়স ৩৭ বৎসর।

    তখনকার দিনে দশ বারোটি সন্তান হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারে শিশুরা চাকর চাকরানির তত্ত্বাবধানেই মানুষ হত। ঠাকুর পরিবারেও সেই নিয়মই প্রচলিত ছিল। এমনকি নবজাত শিশুদের স্তন্যপানের জন্য ধাত্রী নিয়োগ করবার ব্যবস্থাও ছিল।

    সেকালে ঠাকুর বাড়িতে কী ধরণের অবরোধ প্রথা চালু ছিল, তার পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের সহোদরা স্বর্ণকুমারী দেবী এবং মেজোবউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা থেকে।     ঠাকুরবাড়ি ছিল দু ভাগে ভাগ করা – সদর মহল আর অন্দর মহল বাড়ির মহিলারা অন্তঃপুরেই বাস করতেন মেয়েদের একই প্রাঙ্গণে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যেতে হলেও ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কীতে করে যেতে হত আর সঙ্গে থাকতো প্রহরী। সারদা দেবী স্বামীর কাছ থেকে গঙ্গা-স্নানের অনুমতি পেলে বেহারারা পাল্কী-শুদ্ধ তাঁকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে আনতো তাঁর সমস্ত কাজ কর্মই ছিল স্বামীকেন্দ্রিক।

    প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের অতুল বৈভবের মাঝে দেবেন্দ্রনাথ বড় হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতার অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে তিনি পিতার সমস্ত ঋণের বোঝা স্বীকার করে, প্রচুর সম্পত্তি বিক্রি করে সব ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। তারপর শুরু হল আধ্যাত্ম জগতে তাঁর নিঃসঙ্গ আনাগোনা। পারিবারিক ধর্ম সংস্কার, সমাজ, শাস্ত্র - সবকিছুর বাধা নিষেধ আর প্রতিকূলতার মাঝে সত্যের সন্ধানে তিনি বারে বারে হিমালয়ের নির্জনে চলে যেতেন। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনকে তিনি কখনই কোন ভাবে অবহেলা করেননি। বাড়িতে কোন রকম বিলাসিতা না থাকলেও ছেলেমেয়েদের, লেখাপড়া, ছবি আঁকা, সঙ্গীত নানা ব্যপারে তিনি শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। তবে স্বামী প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে সংসার সুন্দর ভাবে পরিচালনা করবার পুরো দায়ীত্ব ছিল সারদা দেবীর উপর।

    খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় "রবীন্দ্রকথা" গ্রন্থে (পৃ ৪২) সারদা দেবী সম্পর্কে লিখেছেন –

"মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে তিনটি সন্তানের জননী হইয়া তেজস্বিনী শাশুড়ীর অবর্তমানে যে সারদা দেবীকে দেবদ্বিজ সমন্বিত নিত্যনৈমিত্তিক কার্য ও উৎসব মুখরিত বৃহৎ সংসারের লোকলৌকিকতা, সামাজিকতা ও যাবতীয় ভার কর্ত্রীরূপে বহন করিতে হয় ও অনতিকাল পরেই দিকপাল সম শ্বশুরের তিরোভাবে বিপ্লবের ঝটিকায় নানাবিধ উদ্বেগ সহিতে হয়, সেই পূজনীয়াকে Heroic Lady বলিলে অত্যুক্তি হয়না।

    পরেও প্রায় ৩০ বৎসর ধরিয়া স্বামীর প্রব্রজ্যা ও শৈল ভ্রমণের মধ্যে অপূর্ব ধীরতার সহিত, কথঞ্চিৎ ভগ্নশরীর লইয়া, এই রমণীকে অতগুলি সন্তান সন্ততির শিক্ষা ও পোষণ এবং তাঁহাদের বিবাহাদি ও শিশুপালন প্রভৃতি সকল কার্যেই কল্যাণ সাধনে নিরত থাকিতে হয়। যথাসাধ্য নিয়মে, শান্তিতে ও প্রফুল্লতায় যে গৃহটিকে পূর্ণ রাখিয়াছিলেন ইহা তাঁহার কম কৃতিত্ব নয়। তাঁহার বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক বলও যে যথেষ্ট ছিল, ইহা হইতে অনুমান করিতে পারি। হিন্দু নারীর আদর্শে শুধু স্বামীর সুখ দুঃখের সঙ্গিনী হইলেই হয়না, সহধর্মিণী হওয়াও যে বাঞ্ছনীয় এ সংস্কার তাঁহার বাল্য, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল ছিল বলিয়াই সকল পরিবর্তনের ভিতর দিয়া তিনি মনের সইত দ্বন্দ্ব করিয়া স্বামীর উপদিষ্ট ধর্মপথে যথাসম্ভব নিজেকে চালিত করিয়া ভিতরের শান্তি ও বাহিরের সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সমর্থা হইয়াছিলেন।"

    যদিও দেবেন্দ্রনাথ বছরের বেশীর ভাগ সময়টুকুই দেশভ্রমণ এবং পাহাড়ে কাটাতেন, কিন্তু যখন তিনি জোড়াসাঁকোয় থাকতেন তখন ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষার দিকে তাঁর সুতীক্ষ্ণ নজর ছিল। বাড়ির ছেলেদের শিক্ষার জন্য ঠাকুরবাড়িতে যে ব্যবস্থা ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি গ্রন্থ থেকে। তার ছোটখাট একটি রেখাচিত্র এখানে দিলাম

    অন্ধকার থাকতে থাকতে বিছানা থেকে ঊঠে কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখা । সকাল সাতটা থেকে নটা লেখাপড়ার সময়। নীলকমল মাস্টার, সীতানাথ দত্ত এবং হেরম্ব তত্ত্বরত্নের কাছে অঙ্ক, বিজ্ঞান মুগ্ধবোধ ইত্যাদি পড়াশোনা। তারপর ভৃত্য গোবিন্দ নিয়ে যেত স্নান করাতে। তারপর আহার শেষে ঘোড়ায় টানা পাল্কীতে করে যেতে হত ইস্কুলে। কবির ভাষায় "দশটা সাড়ে চারটার আন্দামান"বাড়ি এসেই জিমন্যাস্টিকের মাস্টার এবং ছবি আঁকার মাস্টার। সন্ধ্যে বেলা যখন তেলের বাতি জ্বলে উঠত তখন অঘোর মাস্টারের কাছে ইংরাজি পড়া শুরু হত। সোম থেকে শনির এই চক্রের পর রবিবারে ছিল সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা। স্নেহহীন এই সুকঠিন শাসন শিক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকে মাতৃস্নেহ উপভোগ করবার অবকাশ কোথায় ?

      দুপুর বেলা সারদা দেবী ছোট জায়ের সঙ্গে বসে তাস খেলতেন। রবি বা অন্য কোনও ছেলে মেয়েরা মায়ের কাছে সে ঘরে যেতে চাইলে ভৃত্যদের মধ্যে কেউ এসে সরিয়ে নিয়ে যেত (জীবনস্মৃতি ) এইসব ছোটখাট লেখা থেকে সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর ছেলে মেয়েদের সম্পর্কের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

    রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী দেবী "পিতৃস্মৃ্তি" [প্রবাসী ফাল্গুন ১৩১৮ সংখ্যা ] তে লিখেছেন, "আমার মা বহু সন্তানবতী ছিলেন, এইজন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন করিয়া দেখিতে পারিতেন না"

    রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর ভাই বোনেরা মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরেই রইল। তবে অল্প কিছু দিনের জন্যে ছোট্ট রবি তাঁর মায়ের কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেকথাই এখন বলি

    ১২৭৯ (১৮৭২ ইরাজী) সালের ২৫ শে মাঘ – রবির উপনয়ন। সে উপলক্ষে দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় এলেন এবং চৈত্র মাসের শেষে ফেরার সময়  রবিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ডালহৌসি পাহাড়ে মাস কয়েক বাবার সঙ্গে কাটানোর পর রবি কিশোরী চাটুজ্জের সঙ্গে আবার কলকাতায় ফিরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে "জীবন্ত পত্রস্বরূপ"

    ক্ষুদ্র এই জীবন্ত পত্রটি বাড়ি ফিরে এসে কিছুদিন কেবলই জোড়াসাঁকোর ঘরে ঘরে তার ভ্রমণের গল্প করে বেড়াতে লাগলোআর প্রবাসী স্বামীর সংবাদ বহন-কারী রবি তখন সারদা দেবীর কাছে বিশেষ প্রাধান্য পেতে লাগল। এতদিনকার ভৃত্য-রাজতন্ত্র থেকে তার পদোন্নতি ঘটল আর অন্তঃপুরের বাধা গেল ঘুচে

    রবির যখন বয়েস চোদ্দ, তখন সারদা দেবির দেহান্তর ঘটে। জীবনস্মৃতিতে বলেছেন সে রাতের কথা।

"আমরা তখন ঘুমাইতে ছিলাম, তখন কত রাত্রি জানিনা, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, "ওরে তোদের কী সর্বনাশ হলরে !"  তখন বৌ ঠাকুরাণী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন – পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল" এই বৌ ঠাকুরাণী রবির নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবি – তাঁর বয়েস তখন ষোল

    শুধু যে দাসীকে ভর্ৎসনা করে সরিয়ে দিলেন তা নয় – সদ্য মাতৃহীন বালকদের সমস্ত ভার তিনি নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন। রবির জীবনে শৈশবের অনাদর ও অবহেলার দিনগুলির অবসান ঘটলমায়ের স্মৃতি না ভুললেও সদ্য-মাতৃবিয়োগের বেদনাকে হয়তো ভুলতে পেরেছিলেন। ভুলতে পেরেছিলেন কাদম্বরী দেবির স্নেহ স্পর্শে সর্বদা তিনি তাঁর সান্নিধ্য দিয়ে, খাইয়ে পরিয়ে, যত্ন করে, কাছে টেনে মায়ের অভাব ভুলিয়া রাখার চেষ্টা করতেন। নতুন বৌঠানের এই প্রচেষ্টায় রবি মায়ের অভাব তেমন ভাবে অনুভব করতে পারেননি



    তাই বহু বছর পর জীবন স্মৃতি (পৃ ১৬২) তে কবি লিখেছেন –

"যে ক্ষতি পূরণ হইবে না, যে-বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণ-শক্তির একটি প্রধান অঙ্গ; - শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোন আঘাতকে গভীর ভাবে গ্রহণ করেনা, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া রাখেনা। এইজন্য জীবনে প্রথম যে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দে চলিয়া গেল।" তবু রবীন্দ্রনাথের মনে মাতৃস্নেহের জন্যে যে অপরিতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল হয়তো তা কোনদিনও মেটেনি।

 

    রবীন্দ্রনাথের লেখা "শান্তিনিকেতন" -এ মায়ের কথা উনি খুব সুন্দর করে লিখেছেন -

 

"...আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি। আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন - তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। ... আমার হঠাৎ কী হল জানিনে - আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে মা আছেন। তখনি তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধূলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেনঃ তুমি এসেছ!"

     জীবনস্মৃতিতে (পৃ ১৬৩) কবি লিখছেন "ইহার পরে বড়ো হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেল ফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম – তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুল গুলি মনে পড়িত; - আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম, যে-স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার আর অন্ত নাই – তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি"।

        তাঁর বহু বিস্তৃত রচনা সম্ভারের মাঝে কোন কোন লেখা হঠাৎ আমাদের চমকে দেয়। যেমন, বহু সন্তানবতী  জননীর কথা একটি উপমার মাধ্যমে "ছিন্নপত্রে" র একখানি চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে –

"অনেক ছেলের মা যেমন অর্ধমনস্ক সহিষ্ণু ভাবে আপন শিশুদের আনাগোনার প্রতি তেমন দৃকপাত করেন না, তেমনি আমার পৃথিবী এই দুপুরবেলায় ওই আকাশপ্রান্তের দিকে চেয়ে বহু আদিমকালের কথা ভাবছেন, - আমার দিকে তেমন লক্ষ্য করছেন না, আর আমি কেবল অবিশ্রাম বকেই যাচ্ছি"।

    "সোনার তরী" কাব্যগ্রন্থে "শৈশব-সন্ধ্যা"র বর্ণনায় কবি লিখছেন –

                           দাঁড়াইয়া অন্ধকারে

                দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে

                রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,

                সন্ধ্যাশয্যা মার মুখ, দীপের আলোক।

এই কবিতায় শৈশব স্মৃতিতে সন্ধ্যাশয্যা ও দীপের আলোর সঙ্গে মায়ের মুখখানিও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

    আর একটি উদাহরণ - গীতাঞ্জলীর "মাতৃবন্দনা " কবিতাটি :

"জননী তোমার করুণ চরণখানি  হেরিনু আজি এ অরুণ-কিরণ রূপে"

 

 

    সারদা দেবী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং অতগুলি প্রতিভা-সম্পন্ন ছেলেমেয়ের জননী – তবুও তাঁকে স্মরণ করে কেউ কোন কাব্য রচনা করেননি বা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর বিপুল রচনা সম্ভার থেকে কোন গ্রন্থ মায়ের নামে উৎসর্গ করেননি। মাতৃ বিয়োগের সময় তাঁর বয়েস চোদ্দ, কাজেই মায়ের স্মৃতি পুরোপুরি ম্লান হয়ে যাবার কথা নয়। তবু মনে হয় বহু সন্তানবতী হওয়ার কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, সন্তানদের সঙ্গে সারদা দেবির - মা আর সন্তানদের মধ্যেকার যে স্বাভাবিক মধুর সম্পর্ক, সেটি কখনও গড়ে উঠতে পারেনি।

 

    ঠকুরবাড়িতে ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও বিবিধ শিক্ষা দীক্ষার প্রভাবে তাদের মাকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেননতুন যুগের হাওয়া নিয়ে এলেন মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ। আমার ব্যাক্তিগত ধারণা, পরবর্তী যুগে ঠাকুর বাড়ি যে "ঠাকুর বাড়ি" হয়ে উঠেছিল তার কৃতিত্ব অনেকাংশেই সত্যেন্দ্রনাথের পাওনা। তখনকার দিনে ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে স্ত্রীর জন্যে জামা তৈরী করিয়ে, গভর্মেন্ট হাউসে গভর্নল জেনারেলের পার্টিতে স্ত্রীকে একা পাঠিয়ে, আর তারপর দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে জাহাজে একা বিলেত পাঠিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ সে যুগে এক কাণ্ডই করেছিলেন

    জ্যোতিরীন্দ্রনাথ এবং পরে রবীন্দ্রনাথ এই মেজ দাদাটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। যুগসন্ধির সেই ক্রান্তি কালে এই দুঃসাহসী এবং আধুনিক-মনস্ক তরুণটি প্রায় একা হাতেই ভাঙা গড়ার কাজ শুরু করে দেন। ছেলের মতি গতি দেখে সারদা দেবি সবিস্ময়ে একদিন তাকে প্রশ্ন করে ছিলেন, "তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মত গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি?" এইসব মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে তিনি হয়তো মনের দিক থেকে বেশ কিছুটা পুরানো পন্থী ছিলেন

    অবনীন্দ্রনাথের লেখা "ঘরোয়া" থেকে জানতে পারি, কর্তামশাই একটু রাত করে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে স্ত্রীকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাতেন। ডাক পেলে সারদা দেবী তখন একটি ধোওয়া সুতির কাপড় পরে গায়ে একটু আতর মেখে স্বামীর কাছে যেতেন। এই ছিল তাঁর রাতের সাজ     অসম্ভব ফর্সা গায়ের রঙ এবং একটু স্থুল শরীর ছিল তাঁর। দিনের বেলা দেখা হতনা এবং যেহেতু স্বামী বেশীর ভাগ সময় বিদেশে থাকতেন, সারদা দেবী যেন ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তাঁর স্বামীর আদেশ পালন করাই কর্তব্য মনে করতেন। ঠাকুর বাড়িতে মহর্ষির স্ত্রী সারদা দেবীর ছবিটি খুব স্পষ্ট না হলেও বড় স্নিগ্ধ

    জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা "পুরাতনী" থেকে আমরা জানতে পারি যে জীবনের শেষের দিকে সারদা দেবী বেশী নড়াচড়া করতে পারতেন না প্রয়োজনও হতনা সংসারে নিত্য কাজের ভার ছিল দাস দাসীদের পরে তিনি একটি তক্তপোশের উপরে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে থাকতেন আর দাসীরা পুত্রবধূদের রূপটান মাখাতো সামনে বসে এখানে বসেই তিনি অন্তঃপুরের মহিলাদের ঝগড়াঝাঁটি, নানান নালিশের বিচার করতেন

    জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা থেকে সারদা দেবীর সৌন্দর্য প্রীতির কথাও জানতে পারি।

"আমার শাশুড়ী বিকেলে মুখ হাত ধুয়ে তক্তপোশের বিছানায় বসে দাসীদের বলতেন অমুকের ছেলে কি মেয়েকে নিয়ে আয় তারা কোলে করে থাকত, তিনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন, নিজে বড় একটা কোলে নিতেন না যারা সুন্দর তাদেরই ডাকতেন, অন্যদের নয়"

মনে হয়, এটি সম্ভবত সারদা দেবীর একেবারে শেষ দিককার কথা, যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন

    সারদা দেবীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –

"কর্তাদিদিমা আঙুল মটকে মারা যান। বড়োপিসীমার ছোট মেয়ে, সে তখন বাচ্চা কর্তা-দিদিমার আঙুল টিপে দিতে দিতে কেমন করে একটু আঙুল মটকে যায়। সে আর সারেনা, আঙুলে আঙুল-হাড়া হয়ে পেকে উঠল। জ্বর হতে লাগল। কর্তাদিদিমা যান যান অবস্থা। কর্তা-দাদামশাই ছিলেন বাহিরে কর্তা-দিদিমা বলতেন, তোরা ভাবিস নে, আমি কর্তার পায়ের ধূলো মাথায় না নিয়ে মরব না, তোরা নিশ্চিন্ত থাক।"

    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন থাকতেন ডালহৌসি পাহাড়ে। স্ত্রী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাকে শেষ বারের মতো দেখতে এলেন। পতিব্রতা সারদা দেবী সজ্ঞানে স্বামীর পায়ের ধূলো মাথায় নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সে দিনটা ছিল ১২৮১ (ইং ১৮৭৫) সালের ২৫ শে ফাল্গুন। বহু সন্তানবতী সারদা দেবীর জীবনে তাঁর স্বামী এমন ভাবে তাঁর মনে আধিপত্য বিস্তার করে ছিলেন যে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে তিনি শুধু স্বামীর আজ্ঞাই পালন করে গেছেন। স্বাভাবিক মাতৃস্নেহের পরশ দিয়ে তাদের কাছে টেনে নিতে পারেননি।

   

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

 

জীবন-স্মৃতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শান্তিনিকেতন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরাতনী    - জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

কবি মানসী  - জগদীশ ভট্টাচার্য

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল – চিত্রা দেব

ঘরোয়া – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর


কেয়ার টেকার

 


কেয়ার টেকার




 

     আমার নাতনি সুদীপ্তা – গতমাসে ১৭ য় পা দিয়েছে এবং ক'মাস হল ইউনিভার্সিটি যেতে শুরু করেছে যবে থেকে কলেজ শুরু করেছে, আমি ওর মধ্যে একটা ভালো রকম পরিবর্তন লক্ষ করে চলেছি বেশ একটা ফুরফুরে ভাবলেখাপড়া হোম ওয়ার্কের বালাই নেই সাজগোজের দিকেই নজর বেশী কথাবার্তায় বেশ একটা বড় বড় আর সবজান্তা ভাব ওর মা, অর্থাৎ আমার পুত্রবধূ চাকরি করেতাই বিকেল বেলাটা ও ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গেই কাটায় যাই হোক, ওর মনমেজাজ ভালো থাকলেই আমি খুশী

     সেদিন দেখি, কলেজ থেকে ফিরেই দুমদাম্‌ ব্যাগ ট্যাগ এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ ওকে একা থাকতে দিলামতারপর আস্তে আস্তে ওর বিছানায় গিয়ে বসলাম। দেখলাম, চোখ দুটো ভিজে ভিজে লালচে, মুখটাও ফোলা ফোলা। বেশী কিছু জিগেস করতে হলোনা – নিজে থেকেই বললো - শুভময়, অর্থাৎ যে ছেলেটিকে ও মনে মনে ভী – ষণ পছন্দ করছিলো এবং মনে করছিলো যে এই বোধহয় ওর প্রথম এবং শেষ সত্যিকারের প্রেম, তাকে ও পাবার আগেই হারিয়ে ফেলেছে। শুভময়ের বাবা ক্যানাডায় ইমিগ্রেশন পেয়ে গেছেন। আসলে অনেক দিন ধরেই নাকি চেষ্টা করছিলেন। ওরা পরের মাসেই এখান থেকে চলে যাচ্ছে।

     বলতে বলতে নাতনির চোখে আবার ঘন বর্ষা শুরু হল। কী বলবো, ওর মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আমার কোলে মুখ লুকিয়ে ও বললো –

-   "আচ্ছা দিদা, বলো তো – প্রথম প্রেম কি ভোলা যায়?"

-   "যায়, আবার যায়ও না।"

-   "কেন একথা বলছো?"

-   তাহলে তুমি মুখ টুখ ধুয়ে খাবার ঘরে এসো। জলখাবার খেতে খেতে তোমায় একটা গল্প শোনাবো"

     গল্পের নামেই বোধহয়, কান্না ভুলে নাতনি খাবার ঘরে এসে জলখাবার নিয়ে টেবিলে আমার সামনে এসে বসলো। আমি ওকে গল্প বলতে লাগলাম।

     দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে কিছু কিছু লালমুখো সাহেব তখনও পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়তে পারেনি আমাদের পরিবার সাহেব-ঘেঁষা না হলেও, বাবার বন্ধু বিজয় কাকু সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা খুবই পছন্দ করতেন শুনেছি, বাড়িতেও নাকি খাবার সময় টেবিল চেয়ারে বসে কাঁটা চামচ ব্যবহার করতেন বিজয় কাকুর সম্পর্কে এত কথা বলার কারণ আমার গল্পের সঙ্গে তাঁর বেশ কিছুটা যোগাযোগ আছে

     অল্প বয়েস থেকেই আমি বেশ স্বাধীনচেতা আর জেদী মেয়ে ছিলাম দেশশুদ্ধ লোক যখন বৃটিশ-রাজ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলআমি তখন আর এক রকম দাসত্বের কথা চিন্তা করছি আমি মনে করতাম, বিয়ে করাটাও এক ধরণের পরাধীনতা এবং বিয়ে করা মানে একজন পুরুষ মানুষের তাঁবে জীবন কাটানো তাই ঠিক করেছিলাম যে আমি কোনদিনও বিয়ে করবোনা পড়াশোনা করে চাকরি করবো এবং চিরকুমারী থেকে জনকল্যাণের কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করবো মা আমার ওপর মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করলেও আমার সব ব্যাপারে বোধহয় আমার বাবার খানিকটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল, কারণ আমার লেখাপড়া বা অন্য কোন ব্যাপারেই তিনি কোনদিনও কোনও বাধা সৃষ্টি করেননি বরং প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন

     আমাদের ব্রাহ্ম পরিবার তখন বেশ আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে কাজেই আমি বি এ পাশ করবার পরে বেশ তরতর করে এম এ পাশ করে ফেললাম কিন্তু আমার চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো আর হয়ে ওঠেনা এদিকে আমার পুরনো সহপাঠিনীদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে থা করে একবার কেন, বার দুতিন মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে গেছেন আর আমার মনের মতো তো দূরের কথা, কোন চাকরিই জোটেনা এমনি করে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে আর বাবার হোটেলে অন্ন ধ্বংস করতে করতে বছর ঘুরে গেল তারপর একদিন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো একটি চাকরি জুটে গেলসরকারী চাকরি। একধরণের জনকল্যাণের কাজও বটে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে মেয়েদের মধ্যে নিরক্ষরতার পরিসংখ্যান করতে হবে, এবং সেই সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাদের অক্ষর পরিচয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। কয়েকদিন চৌরঙ্গী পাড়ায় হেড অফিসে হাজিরা দিয়ে কাজকর্ম বুঝে নিতে হল। তারপর আমার প্রথম কাজ পড়ল হরিনাভি লাইনে একটা ছোট্ট গ্রামে। গ্রামটির নাম – মাণিকদ – অর্থাৎ মাণিকদহ।

     বাড়িতে এসে কথাটা বলতেই তো বাবা একেবারে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন –

-   "আরে ওই মাণিকদহতেই তো আমাদের বিজয়ের একটা বাংলো, মানে গেষ্ট হাউস আছে। ওখানে ওর একটা পৈত্রিক জমি ছিল, সেখানে বিজয় বেশ সুন্দর একটা একতলা বাড়ি করেছেআগে আগে তো সায়েবসুবোদের নিয়ে খুব পার্টি দিত। নতুন যখন বাড়ি তৈরী হল, তখন আমিও একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। তা সে প্রায় বছর দশেক তো হবেই। মণিকদহ তে যদি থাকবার দরকার হয় তো ওখানেই থাকতে পারবি।"

বাবা ভাল মনে সাহায্য করতে এলেন কিন্তু আমি তা খুশী মনে মেনে নিতে পারলাম না। বললাম-

-   "বাবা, চাকরি সূত্রে আমাকে এখন থেকে হয়তো প্রায়ই এদিক ওদিক কত জায়গায় ঘুরতে হবে। সব জায়গায় তো আর বিজ্যকাকুর বাংলো থাকবেনা।"

বাবা আমার মন খুব ভালোভাবেই বুঝতেন। তাই বললেন –

-   "তা তো বটেই। রাত্রে থাকার ব্যাপার হলে সে ব্যবস্থা তো তোমায় নিজেকেই করতে হবে। তবে এটা তোমার প্রথম কাজদুদিন ভালোভাবে থাকতে পারলে কাজটাও ভালো হবে। আর ভালো কাজ করতে পারলে তোমারও শান্তি আর তোমার ওপর-ওয়ালারও তোমার ওপর আস্থা বাড়বে।"

     সত্যি বলতে কী থাকার ব্যাপার নিয়ে আমারও মনে বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু বাবার কাছে তা স্বীকার করতে লজ্জা। ভাবখানা দেখালাম যেন বিজয়ককুর বাংলোতে থাকতে আমি অনিচ্ছা সত্বেও রাজী হলাম। মনে হল বাবা যেন মুখ ফিরিয়ে একটু হাসি চাপলেন। আমিও না দেখার ভান করলাম।

     বাবার ফোন পাওয়া মাত্র বিজয়কাকু গাড়ি হাঁকিয়ে একেবারে বাংলোর চাবি নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে হাজির। আমাকে বললেন –

-   "তুই চাবি নিয়ে চলে যা। ষ্টেশনে নেমে ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। তবে সঙ্গে তো তোর স্যুটকেস থাকবে। একটা রিক্সা নিয়ে নিবি। মল্লিক সাহেবের বাংলো বললেই যে কেউ দেখিয়ে দেবেএখন একটা গোর্খা বাহাদুর কেয়ার টেকার আছে। ফ্যামিলি কাচ্চা বাচ্চা আছে বলে বাংলোতে থাকেনা। তবে কাছাকাছিই থাকে। খুব ভালো লোক। এর আগেও একটা খুব ভালো কেয়ার টেকার ছিলো – শরণ। একা মানুষ, তাই বাংলোতেই থাকতো। ওসব বাগান টাগান তারই তৈরী। সে আর এখন নেই, এখন এই বাহাদুরই সব দেখাশোনা করে। এও মন্দ নয় – খুব বিশ্বাসী।"

     আমি বলি –

-   "বিজয়কাকু, তোমার বাড়িটা ফাঁকা পাওয়া যাবে তো? তুমি আবার তোমার কোনও লালমুখো সাহেব বন্ধুকে ঢুকিয়ে রাখোনি তো?"

 

বিজয়কাকু তাঁর সেই বিখ্যাত ছাদ ফাটানো অট্টহাসি হেসে বললেন –

-   "আরে না না। মাণিকদহে কয়েকজন সাদা চামড়া এখনও রয়ে গেছে বটে। ওখানে নদীর জল নিয়ে কী একটা এঞ্জিনিয়ারিং প্রজেক্ট এর কাজ চলছিলআমার বাংলোর কাছাকাছি একটা মেস বাড়িতে এখনও বোধ হয় দুচার জন আছে। কাজ শেষ হলেই দেশে ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে আছে। তবে আমার বাংলোর পিছনে ফলের বাগান – সেখানে ওদের কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখলে ঘাবড়ে যাসনা। মানুষগুলো খুবই ভদ্র – এই দুচারটা ফল টল তুলে নিয়ে যায় আর কী। বাহাদুরটা লোকাল লোকেদের একটা ফুলও তুলতে দেয়না, কিন্ত ফিরিঙ্গীদের ফলপাকুড় তুলতে দেখলে কিচ্ছুটি বলেনা। তুই কিচ্ছু ভাবিস না – কবে যাবি বল, আমি বাহাদুরকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।"

     বাহাদুরের কথায় আমার ভরসা বাড়লো। তবুও বোধহয় আমার মুখখানা একটু শুকনো দেখাচ্ছিলো, কারণ বিজয়কাকু বললেন –

-   "ওদিকে মাস দুয়েক যাওয়া হয়নি। এই সুযোগে তোর সঙ্গে আমি আর তোর কাকীমাও চলে যেতাম, কিন্তু পরশু আবার আমরা দুজন তোর কাকীমার বোনঝির বিয়েতে জয়পুর যাচ্ছি। ওখানে পনেরো কুড়ি দিন তো লেগে যাবেই।"

বাবা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন –

-   "না না সুনু আমাদের খুব স্বাধীনচেতা আর সাহসী মেয়ে। এ তো খুব ভালো ব্যবস্থা – ভয় কিসের? এর পর থেকে তো সব যায়গায় একাই যেতে হবে। প্রথম থেকে অভ্যেস করাই ভালো। না হলে তো অফিসে ক'দিন ছুটি নিয়ে আমিই ওর সঙ্গে যেতে পারতাম।"

     যাই হোক তিন দিন পর, একটি ছোট সুটকেসে আমার দু একটি জামাকাপড় এবং একটি ছোট ব্যাগে আমার অফিসের ফাইল পত্র আর বিজয়কাকুর দেওয়া বাংলোর চাবি নিয়ে আমি দুর্গা দুর্গা বলে রওনা দিলাম। বাবা ষ্টেশনে এসে আমায় গাড়িতে তুলে দিলেন আর বললেন –

-   "এটা প্রথম বার, তাই ষ্টেশনে এলাম, এর পর তুই একাই আসতে পারবি।"

     ট্রেনে যে কামরায় উঠলাম, সেটাতে খুব ভীড় না থাকলেও কিছু লোকজন ছিল। এতবড় আইবুড়ো মেয়ে একা একা চলেছে, অনেকেই টেরিয়ে টেরিয়ে তাকালেন, একজন তো আবার সরাসরি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলেন। এম এ পড়বার সময় ক্লাসে বেশ ক'জন পুরুষ সহপাঠী ছিলেন, তবে বেশীর ভাগই বিবাহিত। আমরা তখনকার দিনে তাঁদের সঙ্গে পড়াশোনার কথা ছাড়া অন্য আলাপ আলোচনা করতাম না এবং আপনি বলে কথা বলতাম। তবে ওরই মধ্যে আমার বান্ধবী আশালতা ও অমরবাবুর মধ্যে বেশ একটু প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল। বাড়াবাড়ি কিছু নয়। আমি ওসবের মধ্যে নেই। নিজেকে পুরুষ মানুষের সমকক্ষ ভাবতে ভাবতে প্রায় নিজেকে পুরুষই ভাবতাম।

     আশালতা আমায় বলতো –

-   "আচ্ছা সুনন্দা, তুই এতো কাঠখোট্টা কেন রে? ওই সুদেববাবু তো ঘাড় ঘুরিয়ে সব সময় তোর দিকে দেখেন। আর প্রফেসর বাগচীর তো মনে হয় ক্লাসে একমাত্র তুইই ছাত্রী আছিস – আমরা সব অদৃশ্য।"

     আমি ওর কথায় কান দিই না। আমার কোনদিন কাউকে দেখে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটেনি। যদিও রবি বাবুর লেখা প্রেমের কবিতা গুলো পড়তে ভালোই লাগতো।

     যাই হোক, মাণিকদহ কলকাতার কাছেই। দিনে দিনেই পৌঁছে গেলাম। ষ্টেশনে নেমে দেখি এক গোর্খা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বললো –

-   "আপনি কি মল্লিক সাহেবের কাছ থেকে আসছেন? সুনন্দা দিদি?"

জিগেস করলাম –

-   "হ্যাঁ আমি সুনন্দা – কিন্তু তুমি কী করে জানলে যে আমি এই ট্রেনে আসছি?"

     আমার হাত থেকে ব্যাগ দুটো নিতে নিতে সে জানালো যে ও নাকি সক্কাল থেকেই ষ্টেশনে এসে বসে আছে। তবে ছোট ষ্টেশন তো – আমার এই গাড়িটাই প্রথম গাড়ি যেটা এই ষ্টেশনে থেমেছে। ওকে বললাম –

-   "তুমিই তাহলে বিজয়কাকুর বাহাদুর?" বাহাদুর একগাল হেসে মাথা নাড়লো।

     দুটো সাইকেল রিক্সা করা হল। একটাতে আমি, আর একটাতে বাহাদুর আমার ব্যাগ দুটো নিয়ে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে বিজয়কাকুর বংলোর সামনে রিক্সা থামল। ভাড়া মিটিয়ে ভাল করে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল। গেটের দুপাশে দুটো লতানো গাছ লাগানো। থোকা থোকা গোলাপী ফুলে ভর্তিগেট খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, বাড়ির সামনে ভারী সুন্দর বাগান। একটা সুন্দর গাড়ি বারান্দার ওপর একটা ঘর – সে ঘরে অনেকগুলো কাঁচের জানালা আছেবাহাদুর তালা খুলে দিতে ভেতরটাও ঘুরে ফিরে দেখে নিলাম। মাঝে বেশ বড় একটি হলঘর। সেখানে খাবার টেবিল চেয়ার এবং বসবার ব্যবস্থাও আছে। হলের দুপাশে দুটি করে সবশুদ্ধ চারটি ঘর, এবন প্রতিটি ঘরের সংলগ্ন বাথরুম – খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পিছন দিকে টানা বারান্দা, আর তারপর ছোট্ট একটুকরো বাগান। দেখলাম নানা রকম ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। মনে মনে বিজয়কাকু আর কাকীমার রুচির প্রশংসা না করে পারলামনা।

     বাড়ির বাইরে আমি এর আগে এরকম একা কখনো থাকিনি। হরিদ্বার, রাজগীর, রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত এসব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি বটে, তবে সব সময়েই বাবা, মা, আমার পরের বোন চারু আর ছোট ভাই মান্তুর সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসে দেখছি আমার ভয় ভাবটুকু একেবারেই কেটে গেছে। মনে হয় এত সুন্দর বাংলো আর তার কেয়ার টেকার বাহাদুরকে দেখে।

     দুপুরের ভাত খেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। এখন বাহাদুর চা করে দিল। রাত্রে কী খাবো জিগেস করলো। বাজার করবার টাকা দিতে চাইলে জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে জানালো যে মল্লিক সাহেব টাকা নিতে মানা করেছেন, টাকা নিলে নাকি ওর চাকরি চলা যাবে। বুঝলাম লোকটা সৎ।

     আমি এরপর পায়ে হেঁটে গ্রামে গিয়ে দুচার জনের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। গ্রামটি সম্পর্কে একটা খুব স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি একটা ধারণা হল। দুচার ঘর খুব গরীব মানুষ থাকলেও বাকিদের মনে হয় তেমন খাওয়া পরার ভাবনা নেই। তবে মেয়েদের কেউ অ আ ক খ ও শেখেনি

     সন্ধ্যেবেলা বাংলোতে ফিরে দেখলাম বাহাদুরের রান্না তৈরী ওকে বললাম

-   "বাহাদুর তুমি আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রাখোএতো তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খাওয়ার আমার অভ্যেস নেই তার চেয়ে তুমি বরং এখানে বসো, তোমার সঙ্গে একটু গল্প করি"

আমি মাঝের হলঘরে সোফায় বসলামবাহাদুর বসলো নীচে কার্পেটে আমার প্রথম প্রশ্ন হল

-   "বাহাদুর, তুমি তো বেশ বাংলা বল, কার কাছে শিখলে?"

প্রশংসা শুনে বাহাদুরের মুখে হাসি আর ধরেনা, বলে-

-   "কার কাছে আর দিদি, এই চারপাশের লোকজন, বাংলা ছাড়া আর কেউ তো কিছু বলেনা যখন আমি প্রথম এখানে চাকরিতে ঢুকি, তার দুদিনের মধ্যেই শরণ আমাকে বললে –"বাংলাটা মন দিয়ে শিখে নে, নইলে মুস্কিলে পড়বি"

-   "শরণ? সেই যে আগে এখানকার কেয়ার টেকার ছিল?"

-   "হ্যাঁ দিদি, তবে সে ছিল একা মানুষ, ওই ওপরের ঘরে থাকতোএ বাংলোর খুব দেখভাল করতো আমার চাকরিও এখানে প্রায় পাঁচ ছয় বচ্ছর হয়ে গেল দেশে বউকে রেখে এসেছিলাম তা শরণ বলল- বউ কে দেশে একা ফেলে রেখেছিস কেন, এখানে নিয়ে আয় তবে ওপরের ওই চিলতে ঘরে সুবিধে হবেনা- মল্লিক সাহেবকে বলে, কাছাকাছি আলাদা একটা ঘর দেখে নে তা দিদি আমি তাই করলাম কাছাকাছি একটা ভাঙা চোরা ঘর ছিল, তবে উঠোন কুয়া সব আছে তা সাহেব শুনে সেই ঘর সারিয়ে সুরিয়ে দিলেন বউ এল, এখন আমার দুটো বাচ্চা বাংলোয় কেউ না থাকলে দিনে ঘরেই থাকিআর রাতে লাঠি নিয়ে এসে এখানে পাহারা দিই"

     পাহারা দিতে হয় শুনে আমার একটু অবাক লাগল এত নিস্তরঙ্গ গ্রাম, সেখানে পাহারার দরকার? বাহাদুরকে সে কথা জিগেস করতে সে বলল

-   "না দিদিচোর ডাকাত তো নেই তবে কিনা এলেই হল গরীব লোকপেটের জ্বালায় কী না করে সেই শরণের সময় না কী এক চোর হলঘরে চুরি করতে ঢুকেছিল, তারপর ধরা পড়ে শরণের হাতে বেদম পিট্টি খেয়েছিল"

ওর কথার ধরণে আমি হেসে ফেলি, ওকে বলি

-   "ঠিক আছে বাহাদুরতুমি এবার বাড়ি গিয়ে খেয়ে টেয়ে এসো রাতে না হয় আবার পাহারা দিতে চলে এসো"

-   "হ্যাঁ দিদি, একবার বাড়ি ঘুরে আসি আমার বউ আর ছোট ছেলেটা দুজনেরই বুখার হয়েছে একটু দেখে আসি"

     একবার মনে হল বলি, আহা ওদের অসুখ, তোমাকে আর রাতে পাহারা দিতে আসতে হবেনা তারপর মনে হলনা না আসুক এতো বড় বাড়ি, বাইরে না হয় একটা পাহারাদার থাকল যদি আবার চোর আসে!

     বাহাদুর আমার খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে বাড়ি চলে গেল একটু পরেই আস্তে আস্তে দিনের আলো নিভে আসবে যে ঘরটিতে আমি থাকবো সে ঘরে এসে শাড়ি জামা পাল্টে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম হাওয়া চলাচলের জন্যে বাহাদুর সামনের দিকের একটি জানলা খুলে রেখেছে সুন্দর হাওয়া আসছেরাতে না হয় বন্ধ করে দেব

     কিছুক্ষণ পর পেছনের বারান্দায় কথাবার্তার আওয়াজ শুনে হলঘরের দরজা খুলে পেছনের বারান্দায় এলাম ও মা, বারান্দায় বেশ কিছু বেতের চেয়ার আর নীচু নীচু টেবিল পাতাআর আসর জাঁকিয়ে বসেছে গোটা পাঁচ সাত লালমুখো সায়েব আমি থতমত খেয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পা দুটো যেন মাটিতে কেউ পুঁতে দিয়েছে দাঁড়িয়ে থাকতেও লজ্জাআবার দৌড়ে পালিয়ে যেতেও লজ্জা ওরাও যেন খানিকটা অপ্রস্তুত হঠাত ওদের মধ্যে একজন ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন হাত মেলাতে গিয়েও দুহাত জোড় করে বললেন

-   "আমি রবার্টসনএখানকার রিভার প্রজেক্টের চীফ এঞ্জিনিয়র এঁরা সবাই আমার সহকর্মী আমরা এই পাশেই থাকি মিঃ মল্লিক আমাদের বন্ধু, তাই মাঝে মাঝে আমরা এসে এই বারান্দাতে এসে বসি"

     তারপর উনি খোঁজ নিলেন আমি কে, এই গেস্ট হাউসে থাকছি কী না আড়চোখে দেখলাম, ওঁদের নীচু টেবিলে সরু সরু লম্বা লম্বা বোতল যাইহোক, ইতিমধ্যে আবার একজন অত্যুৎসাহী মধ্যবয়সী সায়েব এগিয়ে এসেছে নিজের পরিচয় দিল মাইক হ্যামিল্টন বলে আমাকে "সুন্দরী মহিলা" বলে সম্বোধন করে আমার নাম জিগেস করল জিগেস করল আমি মিঃ মল্লিকের আত্মীয় কি না, কেন এখানে এসেছিইত্যাদি

     বুকের মধ্যে ধুপ ধুপ করলেও ইংরাজীতে বেশ সপ্রতিভ ভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারার জন্যে মনে মনে বেশ গর্ব অনুভব করছিলাম একবার মনে হল, ইস্‌ বাবা যদি এখন আমাকে দেখতে পেতেন! হঠাত মাইক নামে সাহেবটি বলে বসল

-   "তুমি আমাদের ভেতরে এসে বসতে ইনভাইট করবেনা?"

     এবার আমার অপ্রস্তুত হবার পালা আমাকে বাঁচালেন রবার্টসন মাইকের হাত ধরে টেনে বললেন

-   "আঃ মাইক! এই লেডি কে বিরক্ত কোরনাচলো এখান থেকে" যেতে যেতে মনে হল শুনলাম ওঁর চাপা গলার ধমক – "স্বভাব আর গেলনা তোমার" বাকিটুকু কী বলছেন শোনার জন্যে আমি কী আর সেখানে দাঁড়াই? এক দৌড়ে ঘরে এসে বারান্দার দরজাটা বেশ ভাল ভাবে বন্ধ করে দিলাম

     ঘরে বসে আস্তে আস্তে নিজেকে বোঝালাম, এসব ছোটখাট ঘটনাই তো তোমার অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরিয়ে তুলবে ঘাবড়ে যাবার মতো এমন কিছুই তো হয়নি এম এ পড়বার সময়ও তো ইউনিভার্সিটিতে কত ছেলে ছোকরা বিরক্ত করেছে তবে পেছনের বারান্দায় হলঘরের দরজার ঠিক ওপাশে কয়েকটি বিদেশী লোক বসে বসে মদ্যপান করছেসেটা ভেবেই অস্বস্তিতে মনটা ভরে রইল যাই হোক মিনিট দশেক পরেই বারান্দায় কথাবার্তার আওয়াজ বন্ধ হল, জোর গলায় কয়েক দফা গুড নাইট গুড নাইট শুনে বুঝলাম ওরা চলে গেল এতক্ষণ নিজের ঘরে কাঠ হয়ে বসেছিলামএবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এতক্ষণে ক্ষিদে বোধ হওয়াতে বাহাদুরের ঢাকা দিয়ে রেখে যাওয়া খাবার টেবিলে বসে খেয়ে নিলাম এই সময়টা বাবা, মা, ভাই, বোনএদের কথা খুব মনে পড়ছিল জীবনে এই প্রথম বোধহয় আমি একা বসে খাচ্ছি

     ভাবলাম খাওয়ার পর সামনের উঠোনে অফিসের কাগজপত্র নিয়ে একটু বসি, কিন্তু ধরাতলে উঠোনের চারপাশে বাগানে ফুলের সমারোহ এবং আকাশে বেশ গোলগাল রুপোর থালার মতো চাঁদসব মিলিয়ে মনে হল কোন কাজ না করে চুপচাপ বসে একাকীত্বও বেশ উপভোগ করার মতো জিনিষ কাগজপত্র না হয় আজকের মতো ব্যাগেই বন্দী থাকুক

     উঠোনের একধারে একটি খাটিয়ায় চাদর পাতা ঢাকা গাড়ি বারান্দা ছেড়ে খোলা আকাশের নীচে ওই খাটিয়ায় গিয়ে বসলাম, এবং কিছুক্ষণ পরে শুয়েও পড়লাম সব মিলিয়ে পরিবেশটা এত সুন্দর! যারা চিরকাল কলকাতায় মানুষ, তাদের কাছে এ যেন এক রূপকথার রাজ্য আর আমি যেন এক রাজকন্যা কলকাতার আকাশ ঘোলাটে এখানকার আকাশ পরিষ্কার তাই অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে মাথার ওপর কেউ যেন জরির সামিয়ানা খটিয়ে দিয়েছে

     সারাদিনের নানা ঘটনা হয়ত আমার স্নায়ুকে ক্লান্ত করে ফেলেছিল চোখ বুজে সারাদিনের নানা কথাই ভাবছিলাম মিষ্টি একটা হাওয়ায় নাম না জানা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছেঅদ্ভুত একটা আবেশ একটু বোধহয় চোখ লেগে গিয়েছিল তার মধ্যে মনে হল গাড়ি বারান্দার ওপরের ঘরটাতে কে যেন জানলা বন্ধ করছে আধোঘুমে দেখিহ্যাঁ, ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে এবং একজন মানুষ একটার পর একটা জানলা বন্ধ করছে জানলাগুলোতে কাঁচ লাগানো, তাই তাকে আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম শেষের জানলাটা বন্ধ করতে গিয়ে সে আমায় দেখতে পেল হঠাৎ থমকে গিয়ে সে আমার দিকে তাকালো ও হরি, এই বোধহয় সেই শরণ - শরণ সিংশিখ পাঞ্জাবী, কারণ মাথায় পাগড়ি আছে। ছেলেটি হয়তো আমারই বয়সী হবে। সুশ্রী মুখ, হালকা গোঁফ দাড়ি – আর অদ্ভুত কাজলকালো মায়াময় দুটো চোখ। তার চোখ দুটো এত আশ্চর্য যে আমি যেন চোখ ফেরাতে পারলাম না। সোজা তার দিকে চেয়ে রইলাম। আমি ভুলে গেলাম যে আমি একজন শিক্ষিতা চাকরি করা আধুনিক ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়ে, আর এই ছেলেটি একজন সামান্য কেয়ার টেকার।

     তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই অচেনা ছেলেটির প্রতি অসম্ভব ভালোবাসায় আমার বুকের ভেতরটা ভরে উঠল। সারা গায় কেমন যেন এক শিউরে ওঠা অনুভূতিসেও সোজা নীচে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুখে অল্প হাসি। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানিনা। দশ সেকেন্ড? দশ মিনিট? ওইটুকু সময় মনে হল আমার সারা জীবনের যত না বলা কথা সব বলা হয়ে গেল – আর সেও যেন সব কথা বুঝে নিল। তার জন্যে আমার বুকের ভেতরটা যে ভালোবাসায় ভরে গেছে – সে যেন জেনে গেল। মনে হল এই বিপুল বিশ্ব চরাচরে আর কিছুরই কোন দাম নেই – nothing matters, শুধু ওই মানুষটি আর আমি। এই কি প্রেম? আমার প্রথম প্রেম? 'এসেছ প্রেম এসেছ আজ কী মহা সমারোহে'। আমার একবারও মনে হলোনা – ও যে কে আমি তো তাই জানিনা। বরং মনে হল, ওই দুটো চোখ যেন আমার জন্ম জন্মান্তরের চেনা। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে এভাবে কতক্ষণ কাটলো জানিনা – একসময় সে বলল – "অব চলেঁ?" ও আমায় জিগেস করছে এবার ও যেতে পারে কিনা। আমার মন যেন কানায় কানায় ভরে আছে। আমি চোখের পলক ফেলে সম্মতি জানালাম, চাদরটা আরো ভালো করে গায়ে টেনে নিলাম। শেষ জানলাটি এবার বন্ধ হয়ে গেল – বন্ধ হওয়ার আগে যেন শুনলাম বলল – "আপ অন্দর যা কে সো যাইয়ে।" তারপর ওপরের ঘরের আলো নিভে গেল।

     ও চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার বাইরে থাকার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল। হাওয়ায় একটু শীত শীত করতে লাগল। আমি ঘুম চোখে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে তখনই ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাত নিশ্চয় পেরিয়ে গেছে – একবার যেন কী সব আওয়াজে ঘুমটা একটু পাতলা হয়ে এল। আমার ঘরের জানলাটা কি কেউ খুলে দিয়ে গেল? না তো -বাইরে কী কোন আওয়াজ?

     আমি আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। এবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম – সেই লালমুখো মাইককে- দাঁত বের করে অসভ্যের মতো আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাহাদুরের লাঠির ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। উঠে জল খেলাম, ঘড়িতে সময় দেখলাম রাত দেড়টা। আমার ঘরের জানলাটা শোবার সময় বন্ধ করিনি – দেখলাম সেটা বন্ধবোধহয় বাহাদুর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। বাহাদুর না শরণ? শরণ কি এখনও ওপরের ঘরটাতে থাকে? শরণের কথা – ওর চোখ দুটোর কথা – ভাবতে ভাবতে আবার ঘুম এসে গেল।

     ভোর বেলা ঘুম ভাঙল – পেছনের বাগানে হৈ চৈ এর শব্দে। গতকাল বিকেলে আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে- আমি আর দরজা খুলে বাইরে যাইনি। কী দরকার – আমি আমার নিজের চরখায় তেল দিই। ঘন্টা খানেক পর বাহাদুর চা নিয়ে আমার ঘরের বাইরে থেকে ডাকল। আমিও ততক্ষণে মুখ টুখ ধুয়ে স্নান সেরে তৈরী হয়েই নিয়েছি।

     হলঘরে চা খেতে খেতে ভাহাদুরের কাছে যা কাহিনী শুনলাম, তাতে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। গতকাল সন্ধ্যা বেলা বাহাদুর তার বাড়ি গিয়ে দেখে যে তার বউ আর ছোট ছেলেটার ধুম জ্বর। বড় ছেলেটার বয়েস পাঁচ বছর – একা বসে কাঁদছে। ডাক্তার বাবুর বাড়ি থেকে দাওয়াই এনে ওদের দিয়ে, তারপর রুটি বানিয়ে অদের খাইয়ে নিজে খেয়ে বাহাদুরের নাকি একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। হঠাত শরণের ডাকে ওর ঘুম ভেঙে যায়।

-   "ব্যাটা তুই ঘরে ঘুমোচ্ছিস আর বাংলোয় দিদিমণি একা রয়েছে। দাঁড়া এবার তোর চাকরি কেমন থাকে দেখবো।"

     এই শুনে তো বাহাদুর পড়িমরি করে লাঠি হাতে পাহারা দিতে হাজির। এসে দেখে সব ঠিকঠাকই আছে। বাংলোর সব দরজা জানলা বন্ধ। তাও ও সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে।

     ভোরবেলা গোয়ালা দুধ দিতে এসে বলল

-        "বাহাদুর, তোর বাগানে ঝোপের ধারে এক ব্যাটা সায়েব মদ খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে"

     সেই শুনে বাহাদুর দৌড়ে গিয়ে দেখে মাইক-সায়েব মদ খেয়ে পড়ে নেইঅজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সারা গায়ে লাল নীল মারের দাগ, গলায় পাঁচ আঙুলের ছাপ বাহাদুর তখন তাড়াতাড়ি ওই সাহেবদের মেসে গিয়ে খবর দিয়ে অন্য সাহেবদের ডেকে আনে তারা এসে জলের ঝাপটা দিয়ে ওর জ্ঞান ফিরিয়ে ধরাধরি করে ওকে তুলে নিয়ে যায়

     বাপ্‌রে এসব কী কান্ড! আমি তখনই ঠিক করলাম এখানে আর নয় আজই কলকাতার প্রথম ট্রেনেই বাড়ি ফিরে যাবো চা জলখাবার খেয়ে বাহাদুরকে সব কথা বলতে সে একটু অপ্রস্তুত মুখে চুপ করে থাকলো, তারপর আরও অনেক কথা বলল মনে মনে হয়তো নিজেকে দোষী ভাবছে ঠিক সময় পাহারা দিতে না আসার জন্য তবু শরণ ঠিক সময় ডেকে দেওয়াতে অন্তত দেড়টায় এসেছে সারারাত পাহারা না দিয়ে ঘরে ঘুমিয়ে থাকলে মল্লিক সাহেব ওকে লাথি মেরে দূর করে দিতেন শরণের কাছে ও কৃতজ্ঞ প্রথম প্রথম ও শরণকে আমল দিতনা, কিন্তু এখন ও শরণকে ভালোবাসে, ভক্তি করে আমি বাহাদুরকে জিগেস করলাম

-   "তোমার শরণ কি ওপরের ওই ঘরটাতে থাকে?" ও অবাক হয়ে বলল

-   "না তো!"

     আমি মনে মনে হাসলাম বাহাদুর তো জানেনা, কিন্তু আমি জানিকাল শরণ ওর পুরনো ঘর দেখতে এসে আমাকে দেখেছে যাবার আগে আর একবার দেখা হবে কি? হাতে একটু সময় আছে গোছগাছ সেরে ভাবলাম, একবার মাইকের খবর নিয়ে যাই দেখলাম, ওদের মেসের সামনেও একটু জটলা ডাক্তার এসেছেন, শুনলাম পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছে সায়েব মার খেয়েছে বলে কথা! হয়তো কোন আতংকবাদীর কাজ

     আমাকে দেখে কালকের সেই বয়স্ক সাহেবটিমিঃ রবার্টসন এগিয়ে এলেন ওঁকে মাইকের খবর জিগেস করলাম উনি বললেন

-   "জ্ঞান ফিরেছে, তবে গলায় খুব ব্যথাকষ্ট করে কথা বলছে আর কীবদমাইশির শাস্তি হয়েছে"

আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে উনি বললেন

-   "বলতেও খুব লজ্জা পাচ্ছি কাল রাতে আমরা সব ঘুমিয়ে পড়লে মাইক বাংলোয় গিয়েছিল তোমার ঘরের জানলা খোলা দেখে ওর বিকৃত মন ভেবে নেয় যে তুমি বুঝি ওর জন্যেই জানলা খুলে রেখেছো সে জানলা দিয়ে তোমার ঘরে ঢুকেছিলকিন্তু বাইরে থেকে কে যেন ওর গলা ধরে হিঁচড়ে ওকে বাইরে টেনে আনে তারপর মুখ চেপে বাংলোর পিছন দিকের বাগানে নিয়ে এসে প্রচন্ড মারে এবং গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করে সারা রাত ও ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ভাগ্য ভাল, এ যাত্রা প্রাণে বেঁচেছে পরের সপ্তাহে দেশে ফিরে যাব, জাহাজের টিকিট কাটা লন্ডনে ওর স্ত্রী আর তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ওর পথ চেয়ে বসে আছে"

আমি অবাক হয়ে জিগেস করলাম

-   "কে এমন কাজ করল, কিছু জানা গেল? মাইক কি লোকটাকে চিনতে পেরেছিল?"

রবার্টসন বললেন

-   "না লোকটিকে ও চিনতে পারেনি, শুধু বলেছে, He had a turban onতার মাথায় পাগড়ি ছিল"

     আমি চমকে উঠলাম বলতে না চাইলেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল

-   পাগড়ি ছিল? তার মানে শরণ? শরণ সিং? কাল ও এখানে ছিল মাইকের হাত থেকে কাল ওই তাহলে আমাকে বাঁচিয়েছে"

     মিঃ রবার্টসন কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন

-   "শরণ সিং? এই বাংলোর আগেকার কেয়ার টেকার? কী বলছো তুমি মিস্? সে তো কত বছর আগে একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে!"

     মারা গেছে? নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কাল রাতে ওপরের ঘরে আমি তাহলে কাকে দেখেলাম? কে তাহলে আমাকে মাইকের কাছ থেকে বাঁচালো? কার কাজলকালো চোখের দৃষ্টিতে আমার বুকের মধ্যেটা এমন ওলটপালট হয়ে গেল? আর বাহাদুর? সেও তোনা না সে মারা যায়নিসে আমাদের আশেপাশেই আছে শুধু আমি কোনও দিনও তার কাছে যেতে পারবোনা আমার দুচোখ জ্বালা করে চোখে জল এল চোখের জল লুকোতে আমি দৌড়ে আমার ঘরে চলে এলাম

     আর কখনো শরণের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি তবু শরণ আমার প্রথম প্রেম শরণ আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে আমার শুকনো মনে সরসতা এনেছে

     প্রথমবার একা বাইরে গিয়ে মাইক হ্যামিল্টন সম্পর্কিত এই অভিজ্ঞতার ফলে সে চাকরি করা আর আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি বাড়ির কাছেই একটা মেয়েদের স্কুলে পড়াবার কাজ পেয়েছিলাম এর আট মাস পরে আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম বাবা, মা, বিশেষ করে মা আমার মনের এই পরিবর্তনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন

     নাতনিকে বললাম

-   "তোমার দাদুকে বিয়ে করতে কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? দেখেছিলাম ওর চোখদুটোঅদ্ভুত মায়াভরা বুঝেছিলাম এর সঙ্গে আমার মনের মিল হবে তাই বলছি দিদিভাই, প্রথম প্রেম কী কেউ ভুলতে পারে? আর ভোলার দরকারই বা কী? এখন হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু পরে দেখবে সেই স্মৃতিতে কোনও বেদনা নেই একদিন তুমিও হয়তো তোমার প্রথম ভালোলাগার কথা তোমার নাতনিকে গল্প করে বলবে"

সুদীপ্তা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল

-   "দিদা You are my best friend…" আমি বললাম

-   "ভাগ্যিস বিয়ে করেছিলাম, নইলে তোমার মতো এমন Friend আমি পেতাম কোথায়?"