অপেক্ষা
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। শীতের বেলায়
তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে আসে। এইসময়টা আমার
বড্ড মন খারাপ লাগে। খুব বাবার কথা মনে হয় –
ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
গত বছরের ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। ছোটবেলা থেকেই আমার
ডায়েরি লেখা অভ্যেস। বিয়ের পরেও লেখা থামেনি। তবে সে লেখাগুলো
মোটামুটি দৈনন্ন্দিন জীবনের ঘটনা; যেগুলো বাইরের জগতে রোজ ঘটে – যেমন, কি স্পেশাল
রান্না করলাম, কি সিনেমা দেখলাম, কে বেড়াতে এলো ইত্যাদি। কিন্তু বাইরের
জগতের ঘটনা ছাড়াও মানুষের মনের জগতে অনেক ঘটনা ঘটে চলে। তার কথা আশপাশের
লোকেরা জানতে পারেনা, এমনকি অনেক সময় নিজের কাছেও খবর থাকেনা।
আজ পুরোন ডায়েরিটা দেখতে দেখতে অনেক
ঘটনা মনের মধ্যে ভীড় করে এলো। কি মনে হোল, অনেক দিন পর
আবার খাতা কলম ধরলাম, যেখানে বাইরের জগতের ঘটনা আর মনের জগতে যা ঘটে যায়, তার একটা
মেলবন্ধন ঘটাতে পারি।
অরূপের সঙ্গে
আমার বিয়ে হওয়ার আগে আমার আর একটা ভালোলাগা হয়েছিলো। মানস – মানস রায়। এক বন্ধুর মারফৎ আলাপ। কি করে যে সে
আমাদের বন্ধুদের দলে সামিল হলো মনে নেই, তবে ওকে আমার ভালো লেগে ছিলো। দুদিন সিনেমা
দেখা এবং একদিন বন্ধুদের এড়িয়ে ওর সঙ্গে
গঙ্গাবক্ষে নৌকা-ভ্রমণ। বাড়িতে ধরা পড়ে গেলাম। মানস বিয়ের
প্রস্তাব দিলো আমাকে টেলিফোনে। আমি বি এ পড়ি, কিন্তু
সে চাকরি করে, জাতের অমিল নেই – তবে বাধা কোথায়? বাধা? না তা নেই তবে বাবা একটু কড়া
ধাতের মানুষ। ফতোয়া দিলেন ফাইনাল
পরীক্ষার আগে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। আমি ঠিক করলাম বাবার
কথা শুনে চলবো, কিন্তু মানস শুনতে চাইলোনা। কলেজ থেকে ফেরার সময়
পথে দাঁড়িয়ে থাকতো, কথা বলতে চাইতো, ওর সঙ্গে বেড়াতে যাবার জন্যে জোরাজোরি করতো। শেষ পর্যন্ত
বাবা মা গেলেন ওদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং ফিরে এলেন মুখ কালো করে। ওদের একান্নবর্তি পরিবার। বাড়ির বড়রা নাকি বেশ একটা মোটা অঙ্ক যৌতুক চেয়েছেন। আমি তো অবাক। যৌতুক দিতে বাবাও
রাজি নন আর আমি তো নয়ই – বিশেষতঃ ছেলে যেখানে মেয়েকে পছন্দ করেছে। খুব অপমানিত বোধ
করলাম। ফোনে মানসের সঙ্গে কথা হোলো। সে বললে,
“তুমি তো তোমার বাবার একমাত্র
মেয়ে, ওঁদের অবর্তমানে তুমিই তো সব পাবে – দুদিন আগে আর পরে। তাছাড়া তোমার
বাবার তো অনেক টাকা।“
আমার যেন পায়ের নীচের থেকে মাটি সরে গেলো। ওকে বললাম,
“তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক
নেই, আর কোনোদিন তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করবেনা।“
সে আর কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিয়েছিলাম।
মানস তবুও হাল ছাড়েনি। পথে ঘাটে বিরক্ত
করতো ফোন করে দেখা করতে চাইতো। সে এক বিশ্রী অবস্থা। বন্ধু বান্ধবদের
বা বাবা মার সঙ্গে ছাড়া একা রাস্তায় বেরোনো, বিশেষ করে সন্ধ্যে বেলা বা ছুটির দিনে
মুস্কিল হয়ে পড়েছিলো।
আমি এক সন্তান হলেও নিঃসঙ্গ
ছিলাম না। অন্যান্য ফ্ল্যাটে আমার
ছোট বড় বন্ধু ছিলো, কলেজের বন্ধুরা তো ছিলোই। আমাদের বাড়িতে
সবার অবাধ যাওয়া আসা। তবে তারা আমাদের বাড়ি
আসতো, যত না আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য তার চেয়েও আমার মায়ের
হাতের নিত্য নতুন জলখাবারের জন্য হয়তো। তাই, সে ভাবে আমার
জীবনে মানসের অভাব বোধ করিনি, কিন্তু একটা অপমানের জ্বালা আমাকে ভেতর ভেতর কষ্ট
দিতো।
এবার আসি তার পরের অধ্যায়ে। বি এ পরীক্ষা
দিয়ে বসে আছি। কবে যে রেসাল্ট বের হবে
তার কোন ঠিক নেই। সময় কাটানোর জন্যে মার
কাছে একটু আধটু রান্না শিখছি আর গল্পের বই পড়ছি। এর মধ্যে এক
বান্ধবীর জন্মদিনে তার মাসতুতো দাদা অরূপের সঙ্গে আলাপ। সে নাকি প্রথম
দর্শনেই কুপোকাৎ। আমারও ওকে ভালো লেগেছে,
তবে আমি ঘরপোড়া গরু – খুব সাবধানী।
দুদিন যেতে না যেতেই অরূপ আমার
সেই বান্ধবীকে নিয়ে গাড়ী চালিয়ে আমাদের বাড়ী চলে এলো। আমার বাবা মার সঙ্গে আলাপ
করলো। সপ্রতিভ, ঝকঝকে ছেলে। হাসিখুশী। আমার সঙ্গে বাইরে
ঘোরাঘুরি না করে, সরাসরি বাড়ীতে আমার পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছে, এই
ব্যাপারটা আমার বাবার খুব ভালো লেগেছে।
তার দুদিন পর অরূপের তরফ থেকে
সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব। এবারে প্রথমেই জেনে
নেওয়া হোলো পাত্র পক্ষের কোন দাবী দাওয়া নেই। আমার বাবা মা
আধুনিক মনঃস্ক। মনে করলেন দুজনের আগে
কিছুটা চেনা পরিচয় হওয়া দরকার। যদিও আমার বান্ধবী তার
দাদার নামে ক্যারেক্টার সারটিফিকেট দিয়ে দিয়েছে। বাবা জানালেন,
বাইরে ঘোরাঘুরি নয়, ও বাড়ীতে আসুক – তোমরা গল্প করো, টেলিফোনে আলাপ করো। বাবা অরূপের
অফিসে, পাড়াতেও নানা রকম খোঁজ খবর নিলেন- সবেতেই ফুল মার্কস।
একদিন টেলিফোনে অরূপকে মানসের কথা
বললাম। ও আমাকে রাস্তায় ফলো করে, বিরক্ত করে, এসব শুনে অরূপ তো
রেগেই অস্থির। বললো,
“আমার বাবার পুলিশের অনেক বড়
কর্তাদের সঙ্গে জানাশোনা আছে, ব্যাটাকে জেলের ভাত খাওয়াবো।“
আমার উত্তর ছিলো,
“না না অত বাড়াবাড়ির দরকার নেই।“
অরূপকে আমার বেশ পছন্দ হোল। বিশেষ করে ওর
মধ্যেকার ওই প্রোটেক্টিভ ব্যাপারটা। তা ছাড়া সে সুদর্শন,
সিগারেট খায়না, মদ্য পান করেনা। তবে মনে হল যেন একটু একা
একটু নিডি। ওর মা মারা গেছেন প্রায়
বছর পাঁচ ছয় আগে। বাড়ীতে শুধু বাবা আর
ছেলে। বাবা ছিলেন ফরেস্ট অফিসার, এখন রিটায়ার করে বইপত্র
পড়াশোনা নিয়ে থাকেন।
এভাবে তিন চার মাস কেটে যাওয়ার
পর আমি আমার বাবা মাকে আমার রায় দিলাম। বাবা মা তৈ্রী হচ্ছেন
অরূপদের বাড়ী গিয়ে ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বলে। এর মধ্যে একদিন
অরূপের বাবা, মিঃ রণদেব মুখার্জী, ফোন করে আমাদের বাড়ী এসে হাজির। শীতকাল, তাই
মাথায় টুপি এবং হাতে একটা ছড়ি। দেখে মনে হোলো একটু যেন
সাহেবী-ভাবাপন্ন। আমার বাবা আসুন বসুনের
পালা সাঙ্গ হলে বললেন,
“মিঃ মুখার্জী, আমরা মেয়ে পক্ষ,
আমরাই ভাবছিলাম সামনের ছুটির দিনে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।“ উনি হো হো করে
হেসে উঠে বললেন,
“আরে বাবা আমার ছেলে আপনার
মেয়ের প্রেমে পড়েছে, অতএব পুত্রদায় তো আমারই – তাই আগেভাগে আমিই চলে এলাম। তা ছাড়া অরূপের
কাছে মধুরার কথা এতো শুনেছি যে ওকে দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। মামণি এসো আমার
পাশে এসে বসো।“
কথায় কথায় বেশ অনেকটা সময় কাটলো। দিলখোলা মানুষ। নিজের কতো পেন্সন,
অরূপের মাইনে কতো সব খোলাখুলি বললেন। আর আমরাও যেন ওদের বাড়ি
ঘর-দোর দেখে আসি।
আরও কিছুক্ষণ গল্পসল্পের পর বললেন,
“এবার তো আমায় উঠতে হয়। আমাকে বাড়ি পৌঁছে
ড্রাইভার যাবে অরূপকে আনতে ওর অফিসে। আমি বরাবর বনে জঙ্গলে,
কলকাতার বাইরে কাটিয়েছি। কলকাতার রাস্তা ঘাটে
গাড়ি চালানোর প্রশ্নই ওঠেনা – কলকাতা তেমন আর ভালোও লাগেনা – নেহাৎ পৈত্রিক বাড়িটা
আছে, আর অরূপের চাকরীও এখানে, তাই আমার কলকাতায় থাকা। “
উনি চলে যাবার পর আমি আর বাবা
মা সারাক্ষণ ওঁর কথাই আলোচনা করতে লাগলাম।
পরের সপ্তাহে আমরা গেলাম অরূপদের
বাড়ি দেখতে। পুরোন দিনের দোতলা বাড়ি,
ওপর নীচ মিলিয়ে পাঁচ খানা ঘর। ঘর গুলো সব বিশাল বড় বড়
– আর আসবাব পত্রও সব যেন আগেকার দিনের, সেগুন কাঠের আর খুব ভারী ভারী।
আর দেখা হল মাণিকলালের সঙ্গে। মিঃ মুখার্জীর
রাইট হ্যান্ড ম্যান। মিঃ মুখার্জী ছিলেন
সরকারি চাকুরে – মাণিক লালও তাই – ছিল ওঁর বাবুর্চি। উনি রিটায়ার করবার পর
মাণিকও চাকরি ছেড়ে ওঁর সঙ্গে চলে আসে। এখনও এবাড়ির সব রান্না বান্না সেই করে।
মিঃ মুখার্জী মাণিক কে দেখিয়ে
বললেন,
“এই হচ্ছে আমাদের বাড়ির ওয়ান
এ্যান্ড ওনলি মাণিক – ওকে ছাড়া আমাদের জীবন অচল। ও খুব ভালো রান্না করে। আমি
তো এখন মাঝে মাঝে সময় কাটানোর জন্যে গুগল্ দেখে দেখে নানারকম রেসিপি দেখে ওকে
ইন্সট্রাকশন দিই আর ও রান্না করে দেয়। এইতো সেদিন আমরা, সরি
মাণিক বানিয়েছিলো টাঙ্গরী কাবাব। দারুণ হয়েছিলো। একদিন আপনাদের
খাওয়াবো – আপনারা স্পাইসি খাবার খান তো?”
মা বললেন, “না না - সে কি! একদিন আপনি আর অরূপ আমাদের বাড়ী ডিনার
করুন না। আমিও নেহাৎ খারাপ
রাঁধিনা।“ আবার মিঃ মুখার্জীর
আবার সেই হো হো হাসি।
উনি আমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখালেন। বললেন,
“মধুরা ভালো করে সব দেখে নিক,
আফটার অল ওকেই তো এ বাড়ি নিজের বাড়ি করে নিতে হবে।“
আমার ভালোই লাগলো। এবাড়ি যেন পুরোন
দিনের সব স্মৃতি বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। মিস্তিরির হাত পড়েছে শুধু বাথরুমে
আর দেওয়ালের রঙে। সারা বাড়িতে একটা ছন্নছাড়া ভাব রয়েছে তবে নোংরা নয়। মিঃ মুখার্জীর
ঘরে দেওয়ালে বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়,
রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের ছবি। বললেন,
“এঁরাই আমার ঠাকুর – আমি এঁদেরই
পুজো করি।“
বসবার ঘরে দেওয়ালে অরূপের সঙ্গে
ওর মায়ের ছবি আর মিঃ মুখার্জীর কয়েকটা ছবি, খাকি পোষাক – হাতে বন্দুক। আমি সেদিকে
তাকিয়ে আছি দেখে হেসে বললেন,
“হাতে বন্দুক দেখে ঘাবড়ে যেওনা,
আমি জীবনে সুন্দরবনে একটা রোগা বুড়ো মানুষ-খেকো বাঘ আর কয়েকটা পাখি
ছাড়া আর কিছু মারিনি। বন্দুকের আওয়াজ দরকার মতো জন্তু জানোয়ারদের আর পোচার দের ভয় দেখানোর জন্যে ব্যবহার করা
হোত।“
এর মধ্যে অরূপ অফিস থেকে
ফিরেছে। বলল,
“মধুরা, বাবার বন জঙ্গলের গল্প
একবার শুরু হলে রাত কাবার হয়ে যাবে।“
অরূপের সঙ্গে টেলিফোনে এবং বাড়িতে
গল্পের মাধ্যমে বিয়ের আগে যেটুকু জেনেছি তা বলি।
অরূপ বলতো ওর বাবার স্বভাব একটু বুনো ধরণের। বুনো বলেই ওই চাকরিটা নিয়েছে –
না ওই চাকরিটা নিয়েছে বলেই বুনো হয়েছে – তা বলতে পারবোনা। তবে মা ছিল উল্টো – খুব
সেনসিটিভ, একটু ইন্ট্রোভার্ট। মায়ের একটা
নিজস্ব জগৎ ছিল – আর ছিল ছেলের প্র্তি নিখাদ ভালোবাসা। বাবার বদলির চাকরি তাই অরুপকে হস্টেলে থেকে
পড়াশোনা করতে হয়েছে। বছরে তিনবার
ছুটিতে বাবা মায়ের কাছে আসতো। যতবার চলে আসার সময় হোত, মা অসুস্থ্য হয়ে পড়তেন। ছুটিতে
মা আর ছেলে সব সময় একসঙ্গে। একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, একসঙ্গে টি ভি দেখা, আর নানা
গল্প। মার কাছে অরূপ ছিল বাইরের খোলা জানালা – যা দিয়ে আকাশ দেখা যায়।
বাবা বনে জঙ্গলে ঘোরেন, কাজে
ব্যস্ত। রাত বিরেতে পোচারদের খবর পেলে জীপ নিয়ে বন্দুক ঘাড়ে বেরিয়ে পড়েন। অরূপকে
বলেন, “চল্ না আমার সঙ্গে – চাঁদনী রাতে জঙ্গলের কি অপরূপ সৌন্দর্য দেখবি।“
আরূপ মাথা নাড়ে। বাবা হেসে
বলেন, “মামাস্ বয়।“
অরূপ তখন কলকাতায় কলেজে ঢুকেছে –
মা মারা গেলেন। মায়ের অসুখ ধরা পড়ল - ব্রেন ক্যান্সার। বাবা আর্লি রিটায়ারমেন্ট
নিয়ে মাকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। তারপর নিয়ে গেলেন ভেলোরে। দিনরাত মায়ের কাছে
থেকে সেবা করলেন প্রাণপাত করে – কিন্তু ধরে রাখতে পারলেন না। মাত্র দুতিন মাস
বিছানায় – মা চলে গেলেন। নিঃঃসঙ্গ প্রৌঢ় মানুষটি ছেলেকে হস্টেল থেকে নিয়ে এসে
নিজের কাছে রাখলেন। বাবা, ছেলে আর মাণিক লালকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। অবসরের সাথী হলেন
রবীন্দ্রনাথ।
আমার আর বাবা মার খুব পছন্দ হলো
ওদের বাড়ি। বিয়েটা হয়তো একটু তাড়াহুড়োর মধ্যেই হোল- কারণটা হোল মানস। মনে হোল আমার
বিয়ে হয়ে গেলে ওর জ্বালাতনের হাত থেকে বাঁচবো।
বিয়েতে আমার বাবা মা উজাড় করে দিলেন। আমার শ্বশুর মশাই বললেন,
“শুধু একটা নতুন খাট দেবেন।
নতুন খাটে ফুলশয্যা হবে নতুন দম্পতির। আর কিছু না। যা চাইবার মধুরা চাইবে
তার বাবা মার কাছে। যদি টাকা দিতে চান মধুরার নামে আলাদা ব্যান্ক অ্যাকাউন্ট খুলে
দেবেন এবং আমিও প্রতি মাসে মধুরাকে হাত খরচের টাকা দেবো।“
আমরা তো হেসে বাঁচিনা, শ্বশুর
দেবে হাত খরচের টাকা!
যাইহোক শুভদিন দেখে বিয়ে
সম্পন্ন হোল। আমাদের দিকে ছয়শোর মতো লোক নিমন্ত্রিত, আর ওদের দিকে বরযাত্রী এলো
ষাট জন, তার মধ্যে অরূপের অফিসের লোকজনই বেশী। আমি বাবা মার দেওয়া গয়নার ওপর পেলাম
আমার শাশুড়ীর সব গয়না এবং তাঁর শাশুড়ির ভারি ভারি আগেকার দিনের গয়না। তবে সেসব আমি
তৎক্ষণাৎ লকার-বন্দী করে ফেললাম।
বিয়ের সময় অরূপ অফিস থেকে শুধু
দুদিন ছুটি পেয়েছিল। না আমাদের হানিমুন হয়নি। আসলে বিয়ের দিনটা একটু তাড়াতাড়ি ঠিক
হওয়ায় ঠিকমত যথাসময়ে নোটিশ না দেওয়ায় আরূপের অফিস ওর ছুটি মঞ্জুর করেনি।
আমার শ্বশুর মশাই বললেন, “অমন
চাকরিতে গোলি মারো। আমি তোকে আর মধুরাকে খাওয়াতে পারবনা? তবে চাকরি ছাড়লে তুই
সারাদিন বাড়ি বসে ভেরেন্ডা ভাজবি আর মধুরাকে বিরক্ত করবি। তুই আজকালকার ছেলে –
আমাদের মতো তো আর বই পড়ে সময় কাটাতে শিখিসনি!”
ফুলশয্যা – আমাদের বিয়ের নতুন
খাট, নার্সারি থেকে লোক এসে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। চিরিদিকে ফুল, আমায়
সাজিয়েছে ফুলের গয়না দিয়ে। আমার মনে
তোলপাড়। সারা সন্ধ্যে বন্ধুরা হাসি ঠাট্টা হৈ হুল্লোড় করেছে, কিন্তু আমি মনে মনে নিজেকে
এই বিশেষ রাতটির জন্য প্রস্তুত করছিলাম। একবার মনে হল আমরা সারারাত গল্প করে
কাটাবো। সারা রাত জাগতে পারবো কি? এখনই তো এত ক্লান্ত লাগছে। আচ্ছা ও যদি আমার গান
শুনতে চায়? কি গান গাইবো? মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম একটা পুরোন গান –
“ঘুম ঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা,
এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর – জীবনে আমার
এই চাঁদের তিথিরে বরণ করি “
আমার সারা জীবনের সাথীকে আমি
গানের সুরে বরণ করে নেবো। ধুর, ও যদি হাসে? না না তাহলে সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার
হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতই বেশ হবে। আমি তবে গাইবো -
“আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার
প্রাণ সুরের বাঁধনে তুমি জানোনা,
আমি তোমারে পেয়েছি অজানা
সাধনে।“
গোলাপী বেনারসী – ফুলের মুকুট,
হাতে গলায় ফুলের গয়না। আমি খাটে বসা। অরূপ শেষ বন্ধু বান্ধবদের বিদায় করে ঘরে এলো।
একটা চেয়ার টেনে আমার খাটের পাশে বসলো। কথাবার্তা এইভাবে শুরু হল –
“আমাদের বাড়ির অনুষ্ঠান হয়তো
তোমার পছন্দ হয়নি – আমাদের তো বেশী আত্মীয় স্বজন নেই; তোমাদের দিকে কতো লোকজন।“
“না না – আমার এটাই ভালো
লেগেছে, বেশী ভীড় টিড় আমার পছন্দ নয়।“
“তাই? ভালো। আচ্ছা তুমি ওসব
জবড়জং ফুলের মুকুট টুকুট পরে বসে আছো কেন বলতো? আমি তো এই শীতেও ঘেমে যাচ্ছি।
আচ্ছা দাঁড়াও আমি আগে একটা সেলফি তুলি। সেলফি তোলা হল, গয়না খোলা হল। আরও অনেক
কিছু। অরূপ বলল –
“তোমার নিশ্চয় মানসের সঙ্গে
শারীরিক সম্পর্ক হয়নি, হলে তুমি আমায় নিশ্চয় বলতে। আমি স্বীকার করছি আমি ভার্জিন
নই। তবে খুব ক্যা্সুয়াল অ্যাফেয়ার। নাথিং সিরিয়াস। মধুরা তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। তুমি আমায় পাগল করে
দিয়েছো।“
আমি মনে মনে আরূপকে বললাম –
আমার তেমন কিছু হলে আমি নিশ্চয় তোমায় বলতাম, সে তুমি ভেবেই নিয়েছো, তাহলে তোমার
কথা আমাকে আগে বলোনি কেন?
না না এসব কথা মুখে না আনাই
ভালো – এ রাত মধুরাত, ঝগড়া করবার রাত নয়।
মনের কথা মনেই রয়ে গেলো। এবার
অরুপ তার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বলল, “উফ্ কতদিন এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করেছি!”
আমি কচি খুকি নই। বিয়ের পর কি
হয় না হয় সবই জানা। তবু মনে হল অরূপ এতোটা তাড়াহুড়ো না করলেও পারতো।
সকালে স্নান করে নতুন শাড়ি জামা
পরে খাওয়ার ঘরে এসে দেখি মাণিক চা টোস্ট ইত্যাদি দিয়ে গেছে। শ্বশুর মশাই খবরের
কাগজ পড়ছেন। আমাকে দেখে একগাল হাসি – বললেন,
“সুপ্রভাত! চা না কফি? বাড়িতে
কি খাও?”
“চা ই খাই তো।“
“আচ্ছা মধুরা, তোমার নিজের
বাড়িতে কি তুমি সাতসকালে এরকম ফিটফাট শাড়ি টাড়ি পরে থাকতে নাকি? নিজের বাড়িতে যেমন
থাকতে, এখানেও তেমন থাকবে – কেমন? অরূপ নিশ্চয় আজ বেলা করে উঠবে?”
এই সময় আমার গাল দুটো একটু লাল
হল। উনি দেখলাম সেটা বেশ উপভোগ করলেন।
“মাণিক, তোমার বউদিদিকে
ব্রেকফাস্ট দাও। লুচি আলুর দম খাবে মধুরা? মাণিক খুব চটপট বানিয়ে দিতে পারবে।“
আমি বললাম- “আপনারা খেলে খাবো।”
মনে মনে খুব আনন্দ হল। এ বাড়িতে
উনি আমার এত খেয়াল রাখছেন। কি সুন্দর মানুষ – আমিও ওঁকে খুব যত্ন করবো।
প্রথমে এলো চা বিস্কিট – তারপর লুচি
আলুর দম, সন্দেশ।
আমার শ্বশুর মশাই বললেন –
“মধুরা তুমি আমাকে কাকু জেঠু
আঙ্কল, যা খুশী ডাকতে পারো আবার অরূপের মতো আমাকে বাপী বলেও ডাকতে পারো।“
আমি বাপী বলে ডাকাটাই ঠিক
করলাম।
“তোমার অনারে আজ আমার মর্নিং
ওয়াক বন্ধ। এখন বাজারে যাবো। আজ রান্নার মেনু আমি ঠিক করবো। তবে কাল থেকে তোমার
দায়িত্ব – কেমন?”
আমি বললাম, “যদি আমরা দুজনে
মিলে ঠিক করি?”
“ওরে বাবা! এ মেয়ে তো দেখছি খুব
চালাক। সহজে ধরা দিলোনা। ঠিক আছে তাই হবে।“
আবার সেই টুপি আর ছড়ি। মনে হল
বাঁ পা টা একটু যেন টেনে টেনে হাঁটছেন।
আমি বললাম, “মাণিককে সঙ্গে নিয়ে
যান, এদিকটা আমি সামলে নিতে পারবো।“
মনে হল উনি খুশী হলেন। মাণিক
সঙ্গে গেল। পার্ট টাইম কাজের মেয়েটি এখনো আসেনি। অরূপ ঘুম চোখে সাদা পায়জামা
পাঞ্জাবি পরে খাওয়ার ঘরে এলো। কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে এই ঘরোয়া পোষাকে। এত সুন্দর
আমার বর? ওকে চা টোস্ট দিলাম – সে লুচি খাবেনা, বড্ড তেল ওতে। যতক্ষণ খেলো, বাঁ
হাতে আমার হাত ধরে রইলো। আমার নতুন সংসারের প্রথম দিনটা এইভাবেই শুরু হল।
বেড়ানো গল্প আড্ডা বন্ধুবান্ধব
আর মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাওয়া – ভরপুর জীবন। মাস দুয়েক পর একদিন বাপী আমাকে
বললেন,
“মধুরা তুমি এম এ ক্লাসে ভর্তি
হয়ে যাওনা কেন? কোন চাপ নেই, যে কোন সাবজেক্ট। যা তোমার ভালো লাগে। পড়াশোনার মধ্যে
থাকলে ব্রেন টা ঠিক থাকবে। দেখোনা, এই বুড়ো বয়সেও আমি কতো
পড়াশোনা করি। প্রতিদিন নতুন কিছু পড়ছি শিখছি জানছি।
অবশ্য তুমি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তো আমারই ক্ষতি – কার সঙ্গে গল্প
কোরবো!”
আমি খুশী হয়ে বললাম,
“বাপী আমি আরও পড়াশোনা করতে
চাই। বি এ পরীক্ষায় আমার রেসাল্ট ভালো ছিলো। যদি চান্স পাই ঢুকে যাবো?”
উনি সোচ্চারে বললেন, “নিশ্চয়
যাবে।“
রাত্রে অরূপকে পড়াশোনার কথা
জানালাম। ও বললো,
“ওরে বাবা অত বিদুষী বউ নিয়ে
আমি কি করবো! সন্ধ্যে বেলা আমার জন্যে সময় রাখবে তো? নাকি হোম ওয়ার্ক করতে বসবে?”
“তা তো মাঝে মাঝে আমাকে
পড়াশোনার জন্য ছেড়ে দিতে হবে। আর পরীক্ষার আগে তো বটেই।“
অনেক রকম আলোচনার পরে ঠিক হল,
আমি একটা দুটো করে ক্লাস অডিট করবো, এবং প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবো।
আমার ইউনিভারসিটি যাওয়া শুরু
হল। অডিট করছি বলে কোন চাপ নেই। বেশীর ভাগ ক্লাসেই আমার পুরোন বন্ধুবান্ধবদের দেখা
পেলাম। স্কুলে পড়তে পড়তে বেশ কিছুদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলাম – মাঝে মাঝে বাপীকে
শোনাই, উনি চোখ বন্ধ করে শোনেন। ভালো মন্দ তেমন কিছু বলেন না, শুধু বলেন,
“গানের চর্চাটা ছেড়োনা মধুরা –
গানের মতো জিনিষ নেই। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। মনটাকে কোথায় নিয়ে যায়।“
“আপনার ছেলে তো রবীন্দ্রসঙ্গীত
ভালোবাসেনা – বলে ভীষণ স্লো আর বোরিং।“
“তা কেন – কত রবীন্দ্রসঙ্গীত
আছে খুব তালের – শরীর মন নেচে ওঠে। আমার পা টা ভালো থাকলে ঠিক উঠে নাচতাম।“
“বাপী, আপনার পায়ে কি হয়েছে?”
“সুন্দরবনের জঙ্গলে একবার
বিষাক্ত সাপে কামড়েছিলো – প্রাণটা বেঁচেছে, কিন্তু শরীরের বাঁ দিকটা কিছুটা অবশ। আমার চলাফেরা তাই একটু রেসট্রিকটেড।“
এই প্রৌঢ় আর সাহসী মানুষটার
জন্য আমার মনটা মায়ায় ভরে গেল।
বাপী মাথার কাঁচাপাকা চুলে আঙুল
চালাতে চালাতে বললেন,
“অরূপের পুরো নাম অরূপরতন –
জানোতো?”
“হ্যাঁ বাপী বিয়ের কার্ড এ
তাইতো দেখেছি।“
“আমার এক ছোটবেলাকার বন্ধুর
ঠাকুরদা – রবীন্দ্রনাথের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বন্ধুর নাম অরূপরতন শুনেছি
রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তখন থেকেই ঠিক করেছিলাম যদি আমার কোনদিন ছেলে হয় তার নাম
রাখবো অরূপরতন। আমার পুত্রটি
অবশ্য তার নাম থেকে “রতন” শব্দটি ছেঁটে ফেলেছে।“
“বাপী, আমারও মনের মধ্যে একটা
পছন্দের নাম আছে।“
এ কথাটা বলার সময় কানের কাছটা
একটু গরম ঠেকল। বাপী বোধহয় আমার কথায় মজা পেলেন।
“আচ্ছা? তাই নাকি? কি নাম?”
“এখন বলবো না।“
“তা বেশ। এসো আমরা গীতবিতান
নিয়ে বসে রবীন্দ্রনাথের তালের গান গুলো বাছি। সেগুলো অরূপকে শুনিও। আস্তে আস্তে
দেখবে ব্যাটা ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত হয়ে পড়বে।“
সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের তাক থেকে গীতবিতান
নেমে এলো। আমরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়লাম।
আমার জানা গানের মধ্যে অরূপের জন্য ঠিক করলাম – “প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন
ভুলে” কিন্তু বাপী বললেন –
“না না মধুরা, ওকে আস্তে আস্তে
ইন্ট্রোডিয়ুস করতে হবে। অত শক্ত গানের মানে ও বুঝবেনা। আর মানে না বুঝলে
রবীন্দ্রসঙ্গীত... তার চেয়ে বরং তুমি ওই “পুরানো সেই দিনের কথা দিয়ে শুরু কর।“
সেদিন অরূপ অফিস থেকে ফেরার পরে
চা টা খেয়ে আমরা ছাতে গেলাম। আমি ধরলাম সেই
গান একটু দ্রুত লয়ে –
“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়”।
অরূপ বলল, “তুমি গান গাও তা তো
জানতাম না! পুরানো সেই দিনের কথা – আজ কি তোমার মানসের কথা মনে পড়ছে নাকি?”
আমি চমকে উঠলাম। বললাম, “বাজে
বোকোনা – এই গান বাপী ঠিক করে দিয়েছেন। মানে বোঝা সহজ
বলে।"
অরূপ হাসতে লাগলো, বলল, “আরে –
তুমি এতো সিরিয়াস হচ্ছ কেন? আমি তো ঠাট্টা করছিলাম!”
এর পর আর ছাতের খোলা হাওয়ায়
রবীন্দ্রসঙ্গীত জমলোনা। আমি নীচে নেমে এলাম। একটু পরে আস্তে আস্তে অরূপও।
খাওয়ার টেবিলে বাপী একাই কথা
বলে যেতে লাগলেন। জীব জন্তুর মধ্যে আমার ভালো লাগে বাঘ। তাই উনি খুব মজা করে করে
বাঘের গল্প বলতে লাগলেন।
রাত্রে ঘরে শুতে এসে অরূপ আমার
পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো। বলল – “বিশ্বাস করো আমি তোমার ফিলিংস হার্ট করতে চাইনি।“ তারপর অনেক আদর –
আনেক।
দিন সাতেক পরের কথা। অফিস থেকে
ফিরে জুতো খুলতে খুলতে অরূপ হঠাৎ আমাকে বলল,
“মানস কি তোমার কলেজের সামনে
দাঁড়িয়ে থাকে নাকি?”
“কেন বলোতো?”
“আমার এক কলিগ আজ তোমাদের মেন
গেটের সামনে তোমাকে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন।“
“ভদ্রলোক হলেই সেটা মানস হবে
কেন?”
“তাহলে কে?”
“উনি আমাদের একজন প্র্রফেসর –মধ্যবয়সী,
মাথার সব চুল সাদা। আশ্চর্য তুমি
আমাকে এভাবে জেরা করছ
কেন?”
“সরি। আমি কেমন যেন একটা ভয়ে
ভয়ে থাকি।“
“কিসের ভয়?”
“জানিনা – মাণিকদাকে বলোতো কড়া
করে এক কাপ কফি দিতে। মাথাটা বেশ ধরেছে।“
আরেক দিন আমার বি এ ক্লাসের
কয়েক জন পুরোন বন্ধুর সঙ্গে দল বেঁধে সিনেমা যাওয়ার প্রোগ্রাম হল। সবই বলা ছিল
বাপীকে, অরূপকে। ফেরার পথে ওরা
জেদ ধরল কফি খেতে যাবে। না বলিনি কারণ
ওদের সঙ্গ এতদিন পরে পেয়ে আমার খুব ভাল লাগছিল।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে
গেলো। অরূপ সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমাকে খুব খুশী খুশী
দেখাচ্ছে। সিনেমাতে দল বেঁধে গেলে না একাই কারো সঙ্গে!”
আমার খুব রাগ হল। একটা কি যুৎসই
উত্তর দেবো ভাবছি – কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই বাপী ধমকে উঠলেন –
“ওকি অরূপ – তুমি মধুরার সঙ্গে
অমন অভদ্র ভাবে কথা বলছ কেন?”
অরূপ কিছু না বলে মাথা নীচু করে
নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ওর বোধহয় ধারণা আমাকে যেই দেখে সেই আমার প্রেমে পড়ে
যায়। তবে এই শেষ নয়, যবে থেকে আমি ইউনিভারসিটি যেতে শুরু করেছি, একা বেরোতে শুরু
করেছি, অরূপ এটা সেটা নিয়ে নিত্য এরকম অশান্তি করতে লাগলো।
একদিন দুপুরে বাপী আমাকে ডেকে
বললেন,
“মা রে, তোকে একটু সহনশীল হতে হবে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে অরূপের ব্যাপারে। মাকে ও খুব ভালোবাসতো –
ওর মা ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে বোধহয় ও বড় ইন্সিকিওর ফিল করে। ভয় পায়, ভাবে যাকে
ভালোবাসি সে যদি ছেড়ে চলে যায়?”
আমি আর কি বলবো – মাথা নিচু করে
শুনে গেলাম।
আজকাল আমার মন টন খুব খারাপ
থাকে। এর মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত।
আমার
বাবা ঘুমের মধ্যেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ মারা গেলেন।
মানুষ যখন কিছুদিন রোগে ভুগে মারা যায় তখন পরিবারের লোকের একটা মানসিক প্রস্তুতি
থাকে। আমি আর আমার মা যেন বজ্রাহত হয়ে গেলাম। সারাদিন
খাটে মায়ের পাশে শুয়ে থাকতাম। উঠে যে একটু জল খাব সে ক্ষমতাও যেন ছিল না। সেই সময় আমার এক মেসোমশাই
আর আমার শ্বশুর প্রচন্ড সাহায্য করেছেন। ডাক্তারের সার্টিফিকেট, শ্মশানের কাজ, শ্রাদ্ধের কাজ - সমস্ত দায়িত্ব বাপী নিজের ওপর
তুলে নিলেন। মানিকদাকে দিয়ে রান্না করিয়ে এই বাড়িতে প্রতিদিন পৌঁছে দিতেন।
আমি মেয়ে সন্তান। তায় বিবাহিতা। চার
দিনের দিন শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হল নিয়ম অনুসারে।
সেই
রাত্রে একটা ঘটনা ঘটল। আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম। অরূপ শুতে এসে
আমাকে আদর করতে লাগল। আমি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
“আজ
নয় প্লিজ আমি খুব ক্লান্ত।“
মাত্র
চারদিন হয়েছে আমার বাবা মারা গেছেন, ও এত ইনসেন্সিটিভ কেন? ও আরো
কিছুক্ষণ চেষ্টা চালালো। আমি কাঠের পুতুলের মতন শুয়ে। শেষে ও হাল ছেড়ে দিয়ে
বলল,
“এভাবে রিফিউজড হতে কারো ভালো লাগে? তোমার এই মোরনিং
পিরিয়ড কতদিন চলবে?”
“আমি
জানিনা”
“আমাকে
একটা টাইম লিমিট দিতে হবে!”
“দিতেই
হবে?”
“হ্যাঁ
দিতেই হবে।“
“ঠিক
আছে - এক বছর। লোকে বলে শোকের আয়ু এক বছর।“
অরূপ
কিছু না বলে ওর বালিশ আর চাদর নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।
বাপী সবই দেখলে্ন। কিছু প্রশ্ন করলেন
না। পরদিন রবিবার। বাপী
ইজি চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিলেন। আমার দেখে বললেন,
“আয়
মা আমার কাছে এসে বোস।“
আমি
মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ওঁর কোলে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
উনি আমার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন,
আর বলতে লাগলেন -
“কিছু
চিন্তা করিস না -সব ঠিক হয়ে যাবে -সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো আছি।“
তারপর বললেন,
“কিছু
দিন তোর মায়ের কাছে থেকে আসবি?”
আমার
এই কথাটা আশীর্বাদের মত মনে হলো। অরূপের
সঙ্গ আর এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করতে পারছিলাম না।
কতক্ষন ওঁর কোলে মাথা রেখে এভাবে বসে থেকেছি জানিনা। হঠাৎ অরূপের গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল।
“মধুরা বোধহয় জাদুকরী - জাদু জানে। বাপীকে কেমন বশ করে ফেলেছে!”
বাপী কোন উত্তর দিলেন না। একটু পর আমাকে বললেন,
“যা মা চোখ মুখ ধুয়ে আয়।“ আর মানিকদা কে ডেকে বললেন চা খাবার দিতে।
অরূপ আজকাল সবার সঙ্গেই রাগারাগি করে - তবে আমার প্রতি ওর ব্যবহার
দিন দিন আরও খারাপ হতে থাকলো। শোবার
ঘরের ঝগড়া এখন বাইরের ঘরে চলে আসে।
একদিন খুব বাড়াবাড়ি হল। অরূপ
হঠাৎ আমায় ডেকে বলল,
“তুমি আমার নামে মানিকদাকে কি লাগিয়েছো? আজকাল বুঝি কাজে্র লোকের
সঙ্গেও মন প্রাণের কথা চলছে?”
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কোন রকমে কান্না চেপে বললাম,
“এ কথা কেন বলছ?”
“মাণিকদা আমাকে আজ সকালে বলল, ”দাদাবাবু তুমি বৌদিমণিকে অত কষ্ট
দিও না- বৌদিমণি খুব ভালো মেয়ে।“
আমি উত্তরে কি একটা বলতে গেলাম - হঠাৎ অরূপ খুব জোরে আমায় একটা চড়
মারলো।
আমি আমার মা-বাবার একমাত্র
সন্তান। কেউ কখনো আমার গায়ে হাত তোলে নি। আমার চোখে একসঙ্গে জল আর আগুন।
কোনরকম বললাম,
“তুমি আমাকে মারলে?”
“হ্যাঁ মারলাম! আবার মারবো।“
বলে অরূপ আবার মারার জন্য হাত তুলেছে - হঠাৎ ওদিক থেকে একটা
প্রচন্ড গর্জন!
“অরূপ! খবর্দার!”
তাকিয়ে দেখি বাপীর ঘরের দরজার সামনে উনি দাঁড়িয়ে। হাতে দোনালা বন্দুক অরূপের দিকে তাক করা।
“এত সাহস তোমার! আর এক বার মধুরার গায়ে হাত দাও তোমাকে আমি গুলি
করে মারব! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে - নয়তো আমি পুলিশ ডাকবো।“
অরূপ বাপীর ওই ভয়ংকর মূর্তি
দেখে কেমন যেন গুটিয়ে গেল। আস্তে
আস্তে গেস্ট রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
আমার মা চলে গেছেন দেরাদুনে - মেজো মাসিমার কাছে কিছুদিন থাকতে। আমাদের ফ্ল্যাটটা খালি। আমি চলে গেলাম ওখানে। আসলে আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।
পরদিন সকাল হতেই বাপী ওকে
শহরের নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর অনিল চৌধুরীর কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি অরূপের সঙ্গে একা দু'ঘণ্টা কথা বললেন। আর একটা ব্রেন স্ক্যানের অর্ডার দিলেন। কিছু একটা ধরা পড়েছে। যার জন্য অরূপ এইরকম ইর্যাশনাল
ব্যবহার করছে। যা ধরা
পড়েছে, শুধু ওষুধপত্রে ঠিক না হলে হয়তো সার্জারি বা রেডিয়েশন লাগতে পারে। অরূপের অফিসে মেডিকেল লিভ এর জন্য অ্যাপ্লিকেশন
দেওয়া হল।
ডক্টর চৌধুরীর চেনা একটি হোম - শহর থেকে একটু দূরে নিরিবিলিতে -
বাপী অরূপকে চিকিৎসার জন্য সেখানে রেখে এলেন।
আমাকে টেলিফোনে ডেকে বললেন,
“এবার চলে আয় মা। এই বুড়ো
ছেলেটা আর একা থাকতে পারছে না। ডাক্তার
বলছে কম করে ছয় সাত মাস লাগবে - একটু বেশীও হতে পারে। তবে অরূপ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে।“
আমি এ বাড়ি চলে এসেছি। বাপী কে
ছেড়ে থাকতে আমারও কষ্ট হয়।
আশ্চর্য মানুষ! আমার জন্য
নিজের এক মাত্র ছেলে দিকে বন্দুক
ধরলেন।
এখন বাপী আর আমি দুজনে দুজনকে প্রাণপণ আনন্দে রাখার চেষ্টা করি আর
শুধু অপেক্ষা করি। অরূপের ভালো হয়ে ফিরে আসার অপেক্ষা।
সুপর্ণা মজুমদার, অটোয়া
৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০