Tuesday, October 20, 2020

রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী

 

 

রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবী




 

    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী, রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর জন্ম  ১৮২৬ সালে। ১৮৩৪ সনে বিয়ের সময় তাঁর বয়েস ছিল আট (মতান্তরে ছয়) আর দেবেন্দ্রনাথের বয়স সতের। দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর বড় ছেলে দেবেন্দ্রনাথের বউ আনলেন যশোরের দক্ষিণডিহি থেকে তাঁর বিয়ের আগের নাম ছিল শাকম্ভরী। শ্বশুর দ্বারকানাথ ঠাকুর আর শ্বাশুড়ি দিগম্বরী দেবী। ভরা সংসার। দিগম্বরী দেবী অত্যন্ত ধর্ম-প্রাণা মহিলা ছিলেন। ভোর চারটে থেকে শুরু হত তাঁর পুজো। স্বপাক আহার, নিরম্বু উপবাস, জপ তপ আর ধর্ম গ্রন্থ পাঠ।

    বালিকা সারদা এই পরিবেশে বড় হতে লাগলেন দেবেন্দ্রনাথের পরের ভাই গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী যোগমায়া এবং সারদা দুজনেই কিছুকিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন মাইনে করা বৈষ্ণবী এসে "শিশুবোধক", "রামায়ণ", "মহাভারত", "চাণক্যশ্লোক" ইত্যাদি পড়াতো তার সঙ্গে কলাপাতায় চিঠি লেখা শেখাও চলতো সারদা অবসর পেলেই একটা না একটা বই নিয়ে বসতেন চাণক্যশ্লোক ছিল তাঁর প্রিয় গ্রন্থ মালিনী বটতলা থেকে ছাপা বই এর পসরা নিয়ে আসতোতার থেকে বাড়ির মেয়েরা বেছে বেছে বই কিনতেন

    শ্বাশুড়ি দিগম্বরী দেবীর ধর্মানুরাগের প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল দুই পুত্রবধূ সারদা আর যোগমায়ার পরে তবে দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করার ফলে এই দুজনের জীবন ধারা বয়ে গিয়েছিল দুই ভিন্ন ধারায়।

    ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি সারদা দেবীর তেমন কোন আকর্ষণ না থাকলেও তিনি সরলহৃদয়া পতিব্রতা স্ত্রীর মতো মহর্ষি স্বামীর উপযুক্ত সহধর্মিণী হওয়ারই চেষ্টা করেছেন। তবে এইখানে একটা কথা বলা দরকার। দেবেন্দ্রনাথ পৌত্তলিকতা বিসর্জন দিয়ে একেশ্বর বাদকে অন্তরে ধারণ করে ব্রাহ্ম ধর্মে নিজেকে দীক্ষিত করলেও তিনি বিশেষ ভাবে প্রগতিশীল ছিলেন বলে মনে হয়না। কারণ হিন্দু ধর্মের অনেক সংস্কার তিনি ব্রাহ্ম হয়েও আজীবন পালন করেছেন। যেমন বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা কোনটাই তিনি সমর্থন করতেন না। পারিবারিক প্রথা বা অন্দর মহলের আচার নিয়েও মাথা ঘামান নি। সে সময় ঠাকুর বাড়িতে পর্দা প্রথা বেশ ভালো রকমই চালু ছিল। তাই সারদা দেবীর জীবন যাত্রায় এক বিগ্রহ পুজো ছাড়া আর বিশেষ কোন পরিবর্তন আনতে হয়নি।

    সারদা দেবীর বারো বছর বয়সে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন – সেটি বাঁচেনি। এর পরে আগামী পঁচিশ বৎসরের মধ্যে সারদা দেবী পনেরোটি পুত্র কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান কখনো দু বৎসর কখনো বা তারও কম শুধু নবম এবং দশম সন্তানের মধ্যে বয়সের ব্যবধান চার বৎসর শেষ দিকে ছটি সন্তানের জন্ম হয়েছে আট বৎসরের মধ্যে শেষ সন্তান বুধেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৩ সালে, তখন সারদা দেবীর বয়স ৩৭ বৎসর।

    তখনকার দিনে দশ বারোটি সন্তান হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারে শিশুরা চাকর চাকরানির তত্ত্বাবধানেই মানুষ হত। ঠাকুর পরিবারেও সেই নিয়মই প্রচলিত ছিল। এমনকি নবজাত শিশুদের স্তন্যপানের জন্য ধাত্রী নিয়োগ করবার ব্যবস্থাও ছিল।

    সেকালে ঠাকুর বাড়িতে কী ধরণের অবরোধ প্রথা চালু ছিল, তার পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের সহোদরা স্বর্ণকুমারী দেবী এবং মেজোবউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লেখা থেকে।     ঠাকুরবাড়ি ছিল দু ভাগে ভাগ করা – সদর মহল আর অন্দর মহল বাড়ির মহিলারা অন্তঃপুরেই বাস করতেন মেয়েদের একই প্রাঙ্গণে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যেতে হলেও ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কীতে করে যেতে হত আর সঙ্গে থাকতো প্রহরী। সারদা দেবী স্বামীর কাছ থেকে গঙ্গা-স্নানের অনুমতি পেলে বেহারারা পাল্কী-শুদ্ধ তাঁকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে আনতো তাঁর সমস্ত কাজ কর্মই ছিল স্বামীকেন্দ্রিক।

    প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের অতুল বৈভবের মাঝে দেবেন্দ্রনাথ বড় হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতার অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে তিনি পিতার সমস্ত ঋণের বোঝা স্বীকার করে, প্রচুর সম্পত্তি বিক্রি করে সব ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। তারপর শুরু হল আধ্যাত্ম জগতে তাঁর নিঃসঙ্গ আনাগোনা। পারিবারিক ধর্ম সংস্কার, সমাজ, শাস্ত্র - সবকিছুর বাধা নিষেধ আর প্রতিকূলতার মাঝে সত্যের সন্ধানে তিনি বারে বারে হিমালয়ের নির্জনে চলে যেতেন। কিন্তু গার্হস্থ্য জীবনকে তিনি কখনই কোন ভাবে অবহেলা করেননি। বাড়িতে কোন রকম বিলাসিতা না থাকলেও ছেলেমেয়েদের, লেখাপড়া, ছবি আঁকা, সঙ্গীত নানা ব্যপারে তিনি শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। তবে স্বামী প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে সংসার সুন্দর ভাবে পরিচালনা করবার পুরো দায়ীত্ব ছিল সারদা দেবীর উপর।

    খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় "রবীন্দ্রকথা" গ্রন্থে (পৃ ৪২) সারদা দেবী সম্পর্কে লিখেছেন –

"মাত্র ১৮ বৎসর বয়সে তিনটি সন্তানের জননী হইয়া তেজস্বিনী শাশুড়ীর অবর্তমানে যে সারদা দেবীকে দেবদ্বিজ সমন্বিত নিত্যনৈমিত্তিক কার্য ও উৎসব মুখরিত বৃহৎ সংসারের লোকলৌকিকতা, সামাজিকতা ও যাবতীয় ভার কর্ত্রীরূপে বহন করিতে হয় ও অনতিকাল পরেই দিকপাল সম শ্বশুরের তিরোভাবে বিপ্লবের ঝটিকায় নানাবিধ উদ্বেগ সহিতে হয়, সেই পূজনীয়াকে Heroic Lady বলিলে অত্যুক্তি হয়না।

    পরেও প্রায় ৩০ বৎসর ধরিয়া স্বামীর প্রব্রজ্যা ও শৈল ভ্রমণের মধ্যে অপূর্ব ধীরতার সহিত, কথঞ্চিৎ ভগ্নশরীর লইয়া, এই রমণীকে অতগুলি সন্তান সন্ততির শিক্ষা ও পোষণ এবং তাঁহাদের বিবাহাদি ও শিশুপালন প্রভৃতি সকল কার্যেই কল্যাণ সাধনে নিরত থাকিতে হয়। যথাসাধ্য নিয়মে, শান্তিতে ও প্রফুল্লতায় যে গৃহটিকে পূর্ণ রাখিয়াছিলেন ইহা তাঁহার কম কৃতিত্ব নয়। তাঁহার বুদ্ধিমত্তা ও আধ্যাত্মিক বলও যে যথেষ্ট ছিল, ইহা হইতে অনুমান করিতে পারি। হিন্দু নারীর আদর্শে শুধু স্বামীর সুখ দুঃখের সঙ্গিনী হইলেই হয়না, সহধর্মিণী হওয়াও যে বাঞ্ছনীয় এ সংস্কার তাঁহার বাল্য, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের মধ্যে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল ছিল বলিয়াই সকল পরিবর্তনের ভিতর দিয়া তিনি মনের সইত দ্বন্দ্ব করিয়া স্বামীর উপদিষ্ট ধর্মপথে যথাসম্ভব নিজেকে চালিত করিয়া ভিতরের শান্তি ও বাহিরের সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সমর্থা হইয়াছিলেন।"

    যদিও দেবেন্দ্রনাথ বছরের বেশীর ভাগ সময়টুকুই দেশভ্রমণ এবং পাহাড়ে কাটাতেন, কিন্তু যখন তিনি জোড়াসাঁকোয় থাকতেন তখন ছেলে মেয়েদের সুশিক্ষার দিকে তাঁর সুতীক্ষ্ণ নজর ছিল। বাড়ির ছেলেদের শিক্ষার জন্য ঠাকুরবাড়িতে যে ব্যবস্থা ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি গ্রন্থ থেকে। তার ছোটখাট একটি রেখাচিত্র এখানে দিলাম

    অন্ধকার থাকতে থাকতে বিছানা থেকে ঊঠে কানা পালোয়ানের কাছে কুস্তি শেখা । সকাল সাতটা থেকে নটা লেখাপড়ার সময়। নীলকমল মাস্টার, সীতানাথ দত্ত এবং হেরম্ব তত্ত্বরত্নের কাছে অঙ্ক, বিজ্ঞান মুগ্ধবোধ ইত্যাদি পড়াশোনা। তারপর ভৃত্য গোবিন্দ নিয়ে যেত স্নান করাতে। তারপর আহার শেষে ঘোড়ায় টানা পাল্কীতে করে যেতে হত ইস্কুলে। কবির ভাষায় "দশটা সাড়ে চারটার আন্দামান"বাড়ি এসেই জিমন্যাস্টিকের মাস্টার এবং ছবি আঁকার মাস্টার। সন্ধ্যে বেলা যখন তেলের বাতি জ্বলে উঠত তখন অঘোর মাস্টারের কাছে ইংরাজি পড়া শুরু হত। সোম থেকে শনির এই চক্রের পর রবিবারে ছিল সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা। স্নেহহীন এই সুকঠিন শাসন শিক্ষা ব্যবস্থার ফাঁকে মাতৃস্নেহ উপভোগ করবার অবকাশ কোথায় ?

      দুপুর বেলা সারদা দেবী ছোট জায়ের সঙ্গে বসে তাস খেলতেন। রবি বা অন্য কোনও ছেলে মেয়েরা মায়ের কাছে সে ঘরে যেতে চাইলে ভৃত্যদের মধ্যে কেউ এসে সরিয়ে নিয়ে যেত (জীবনস্মৃতি ) এইসব ছোটখাট লেখা থেকে সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর ছেলে মেয়েদের সম্পর্কের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

    রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী দেবী "পিতৃস্মৃ্তি" [প্রবাসী ফাল্গুন ১৩১৮ সংখ্যা ] তে লিখেছেন, "আমার মা বহু সন্তানবতী ছিলেন, এইজন্য তিনি আমাদের সকলকে তেমন করিয়া দেখিতে পারিতেন না"

    রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর ভাই বোনেরা মায়ের কাছ থেকে দূরে দূরেই রইল। তবে অল্প কিছু দিনের জন্যে ছোট্ট রবি তাঁর মায়ের কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেকথাই এখন বলি

    ১২৭৯ (১৮৭২ ইরাজী) সালের ২৫ শে মাঘ – রবির উপনয়ন। সে উপলক্ষে দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় এলেন এবং চৈত্র মাসের শেষে ফেরার সময়  রবিকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ডালহৌসি পাহাড়ে মাস কয়েক বাবার সঙ্গে কাটানোর পর রবি কিশোরী চাটুজ্জের সঙ্গে আবার কলকাতায় ফিরে এলেন। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে "জীবন্ত পত্রস্বরূপ"

    ক্ষুদ্র এই জীবন্ত পত্রটি বাড়ি ফিরে এসে কিছুদিন কেবলই জোড়াসাঁকোর ঘরে ঘরে তার ভ্রমণের গল্প করে বেড়াতে লাগলোআর প্রবাসী স্বামীর সংবাদ বহন-কারী রবি তখন সারদা দেবীর কাছে বিশেষ প্রাধান্য পেতে লাগল। এতদিনকার ভৃত্য-রাজতন্ত্র থেকে তার পদোন্নতি ঘটল আর অন্তঃপুরের বাধা গেল ঘুচে

    রবির যখন বয়েস চোদ্দ, তখন সারদা দেবির দেহান্তর ঘটে। জীবনস্মৃতিতে বলেছেন সে রাতের কথা।

"আমরা তখন ঘুমাইতে ছিলাম, তখন কত রাত্রি জানিনা, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, "ওরে তোদের কী সর্বনাশ হলরে !"  তখন বৌ ঠাকুরাণী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন – পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল" এই বৌ ঠাকুরাণী রবির নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবি – তাঁর বয়েস তখন ষোল

    শুধু যে দাসীকে ভর্ৎসনা করে সরিয়ে দিলেন তা নয় – সদ্য মাতৃহীন বালকদের সমস্ত ভার তিনি নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন। রবির জীবনে শৈশবের অনাদর ও অবহেলার দিনগুলির অবসান ঘটলমায়ের স্মৃতি না ভুললেও সদ্য-মাতৃবিয়োগের বেদনাকে হয়তো ভুলতে পেরেছিলেন। ভুলতে পেরেছিলেন কাদম্বরী দেবির স্নেহ স্পর্শে সর্বদা তিনি তাঁর সান্নিধ্য দিয়ে, খাইয়ে পরিয়ে, যত্ন করে, কাছে টেনে মায়ের অভাব ভুলিয়া রাখার চেষ্টা করতেন। নতুন বৌঠানের এই প্রচেষ্টায় রবি মায়ের অভাব তেমন ভাবে অনুভব করতে পারেননি



    তাই বহু বছর পর জীবন স্মৃতি (পৃ ১৬২) তে কবি লিখেছেন –

"যে ক্ষতি পূরণ হইবে না, যে-বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণ-শক্তির একটি প্রধান অঙ্গ; - শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে, তখন সে কোন আঘাতকে গভীর ভাবে গ্রহণ করেনা, স্থায়ী রেখায় আঁকিয়া রাখেনা। এইজন্য জীবনে প্রথম যে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলিয়া প্রবেশ করিল, তাহা আপনার কালিমাকে চিরন্তন না করিয়া ছায়ার মতোই একদিন নিঃশব্দে চলিয়া গেল।" তবু রবীন্দ্রনাথের মনে মাতৃস্নেহের জন্যে যে অপরিতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল হয়তো তা কোনদিনও মেটেনি।

 

    রবীন্দ্রনাথের লেখা "শান্তিনিকেতন" -এ মায়ের কথা উনি খুব সুন্দর করে লিখেছেন -

 

"...আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি। আমি নিতান্ত বালককালে মাতৃহীন। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারে বাগানবাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন - তাঁর আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। ... আমার হঠাৎ কী হল জানিনে - আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে মা আছেন। তখনি তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর পায়ের ধূলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেনঃ তুমি এসেছ!"

     জীবনস্মৃতিতে (পৃ ১৬৩) কবি লিখছেন "ইহার পরে বড়ো হইলে যখন বসন্ত প্রভাতে একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেল ফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম – তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলি ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুল গুলি মনে পড়িত; - আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম, যে-স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার আর অন্ত নাই – তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি"।

        তাঁর বহু বিস্তৃত রচনা সম্ভারের মাঝে কোন কোন লেখা হঠাৎ আমাদের চমকে দেয়। যেমন, বহু সন্তানবতী  জননীর কথা একটি উপমার মাধ্যমে "ছিন্নপত্রে" র একখানি চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে –

"অনেক ছেলের মা যেমন অর্ধমনস্ক সহিষ্ণু ভাবে আপন শিশুদের আনাগোনার প্রতি তেমন দৃকপাত করেন না, তেমনি আমার পৃথিবী এই দুপুরবেলায় ওই আকাশপ্রান্তের দিকে চেয়ে বহু আদিমকালের কথা ভাবছেন, - আমার দিকে তেমন লক্ষ্য করছেন না, আর আমি কেবল অবিশ্রাম বকেই যাচ্ছি"।

    "সোনার তরী" কাব্যগ্রন্থে "শৈশব-সন্ধ্যা"র বর্ণনায় কবি লিখছেন –

                           দাঁড়াইয়া অন্ধকারে

                দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে

                রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,

                সন্ধ্যাশয্যা মার মুখ, দীপের আলোক।

এই কবিতায় শৈশব স্মৃতিতে সন্ধ্যাশয্যা ও দীপের আলোর সঙ্গে মায়ের মুখখানিও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

    আর একটি উদাহরণ - গীতাঞ্জলীর "মাতৃবন্দনা " কবিতাটি :

"জননী তোমার করুণ চরণখানি  হেরিনু আজি এ অরুণ-কিরণ রূপে"

 

 

    সারদা দেবী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী এবং অতগুলি প্রতিভা-সম্পন্ন ছেলেমেয়ের জননী – তবুও তাঁকে স্মরণ করে কেউ কোন কাব্য রচনা করেননি বা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও তাঁর বিপুল রচনা সম্ভার থেকে কোন গ্রন্থ মায়ের নামে উৎসর্গ করেননি। মাতৃ বিয়োগের সময় তাঁর বয়েস চোদ্দ, কাজেই মায়ের স্মৃতি পুরোপুরি ম্লান হয়ে যাবার কথা নয়। তবু মনে হয় বহু সন্তানবতী হওয়ার কারণেই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন, সন্তানদের সঙ্গে সারদা দেবির - মা আর সন্তানদের মধ্যেকার যে স্বাভাবিক মধুর সম্পর্ক, সেটি কখনও গড়ে উঠতে পারেনি।

 

    ঠকুরবাড়িতে ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও বিবিধ শিক্ষা দীক্ষার প্রভাবে তাদের মাকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেননতুন যুগের হাওয়া নিয়ে এলেন মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ। আমার ব্যাক্তিগত ধারণা, পরবর্তী যুগে ঠাকুর বাড়ি যে "ঠাকুর বাড়ি" হয়ে উঠেছিল তার কৃতিত্ব অনেকাংশেই সত্যেন্দ্রনাথের পাওনা। তখনকার দিনে ফরাসী দোকানে ফরমাশ দিয়ে স্ত্রীর জন্যে জামা তৈরী করিয়ে, গভর্মেন্ট হাউসে গভর্নল জেনারেলের পার্টিতে স্ত্রীকে একা পাঠিয়ে, আর তারপর দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে জাহাজে একা বিলেত পাঠিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ সে যুগে এক কাণ্ডই করেছিলেন

    জ্যোতিরীন্দ্রনাথ এবং পরে রবীন্দ্রনাথ এই মেজ দাদাটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন মাত্র। যুগসন্ধির সেই ক্রান্তি কালে এই দুঃসাহসী এবং আধুনিক-মনস্ক তরুণটি প্রায় একা হাতেই ভাঙা গড়ার কাজ শুরু করে দেন। ছেলের মতি গতি দেখে সারদা দেবি সবিস্ময়ে একদিন তাকে প্রশ্ন করে ছিলেন, "তুই মেয়েদের নিয়ে মেমদের মত গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি?" এইসব মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায় যে তিনি হয়তো মনের দিক থেকে বেশ কিছুটা পুরানো পন্থী ছিলেন

    অবনীন্দ্রনাথের লেখা "ঘরোয়া" থেকে জানতে পারি, কর্তামশাই একটু রাত করে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে স্ত্রীকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাতেন। ডাক পেলে সারদা দেবী তখন একটি ধোওয়া সুতির কাপড় পরে গায়ে একটু আতর মেখে স্বামীর কাছে যেতেন। এই ছিল তাঁর রাতের সাজ     অসম্ভব ফর্সা গায়ের রঙ এবং একটু স্থুল শরীর ছিল তাঁর। দিনের বেলা দেখা হতনা এবং যেহেতু স্বামী বেশীর ভাগ সময় বিদেশে থাকতেন, সারদা দেবী যেন ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তাঁর স্বামীর আদেশ পালন করাই কর্তব্য মনে করতেন। ঠাকুর বাড়িতে মহর্ষির স্ত্রী সারদা দেবীর ছবিটি খুব স্পষ্ট না হলেও বড় স্নিগ্ধ

    জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা "পুরাতনী" থেকে আমরা জানতে পারি যে জীবনের শেষের দিকে সারদা দেবী বেশী নড়াচড়া করতে পারতেন না প্রয়োজনও হতনা সংসারে নিত্য কাজের ভার ছিল দাস দাসীদের পরে তিনি একটি তক্তপোশের উপরে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে থাকতেন আর দাসীরা পুত্রবধূদের রূপটান মাখাতো সামনে বসে এখানে বসেই তিনি অন্তঃপুরের মহিলাদের ঝগড়াঝাঁটি, নানান নালিশের বিচার করতেন

    জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা থেকে সারদা দেবীর সৌন্দর্য প্রীতির কথাও জানতে পারি।

"আমার শাশুড়ী বিকেলে মুখ হাত ধুয়ে তক্তপোশের বিছানায় বসে দাসীদের বলতেন অমুকের ছেলে কি মেয়েকে নিয়ে আয় তারা কোলে করে থাকত, তিনি চেয়ে চেয়ে দেখতেন, নিজে বড় একটা কোলে নিতেন না যারা সুন্দর তাদেরই ডাকতেন, অন্যদের নয়"

মনে হয়, এটি সম্ভবত সারদা দেবীর একেবারে শেষ দিককার কথা, যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন

    সারদা দেবীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –

"কর্তাদিদিমা আঙুল মটকে মারা যান। বড়োপিসীমার ছোট মেয়ে, সে তখন বাচ্চা কর্তা-দিদিমার আঙুল টিপে দিতে দিতে কেমন করে একটু আঙুল মটকে যায়। সে আর সারেনা, আঙুলে আঙুল-হাড়া হয়ে পেকে উঠল। জ্বর হতে লাগল। কর্তাদিদিমা যান যান অবস্থা। কর্তা-দাদামশাই ছিলেন বাহিরে কর্তা-দিদিমা বলতেন, তোরা ভাবিস নে, আমি কর্তার পায়ের ধূলো মাথায় না নিয়ে মরব না, তোরা নিশ্চিন্ত থাক।"

    মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন থাকতেন ডালহৌসি পাহাড়ে। স্ত্রী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাকে শেষ বারের মতো দেখতে এলেন। পতিব্রতা সারদা দেবী সজ্ঞানে স্বামীর পায়ের ধূলো মাথায় নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সে দিনটা ছিল ১২৮১ (ইং ১৮৭৫) সালের ২৫ শে ফাল্গুন। বহু সন্তানবতী সারদা দেবীর জীবনে তাঁর স্বামী এমন ভাবে তাঁর মনে আধিপত্য বিস্তার করে ছিলেন যে ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যাপারে তিনি শুধু স্বামীর আজ্ঞাই পালন করে গেছেন। স্বাভাবিক মাতৃস্নেহের পরশ দিয়ে তাদের কাছে টেনে নিতে পারেননি।

   

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

 

জীবন-স্মৃতি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শান্তিনিকেতন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরাতনী    - জ্ঞানদানন্দিনী দেবী

কবি মানসী  - জগদীশ ভট্টাচার্য

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল – চিত্রা দেব

ঘরোয়া – অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর


1 comment:

Sharmishtha Basu said...

great post. I knew nothing about my favorite poet;s mother! ha!