সোমনাথ আর কাজল গরম কালে ছাদের ঘর ছেড়ে
একতলার একটা ঘরে জিনিষ পত্র নিয়ে নেমে এলো। ওপরে এত গরম যে টেঁকা যায়না। ইলেকট্রিসিটি নেই, কাজেই ফ্যান বা এ সি র প্রশ্ন নেই। নীচের ঘরের সামনে ঢাকা বারান্দা, তাতে গরমটা একটু কম লাগে। তার ওপর দরজা জানলায় খসখস বলে একরকম ঘাসের
মোটা পর্দা টাঙানো,
তাতে মঙ্গল অহরহ বালতি করে জল এনে ছিটিয়ে
দেয়।
সেই খসখসের পর্দার মধ্যে দিয়ে যে হাওয়া
আসে তা মোটামুটি ঠান্ডা আর একটা সুন্দর গন্ধ আছে।
কাজল একটা ব্যাটারীর ট্রানসিসটর আনিয়েছে
জয়পুর থেকে।
রোজ দুপুরে সেটা চালিয়ে শুয়ে থাকে। বেশীর ভাগ দিন সোমনাথও খানিকটা লম্বা
বিশ্রাম নেয়,
তারপর রোদ পড়লে হাসপাতালে চলে যায়।
তবে
তেমন রোগী চলে এলে কেউ না কেউ এসে ডেকে নিয়ে যায়।
কুকুরগুলো লম্বা জিভ বের করে হা হা করে
হাঁপায়।
ছাগল চরানো ছোট ছেলেরা ছাগল গুলোকে বড়
গাছের ছায়ায় বসিয়ে রাখে।
এই ছেলেগুলোর পরনে কাপড় না জুটলেও মাথায়
কিছু একটা পাগড়ীর মতো করে বাঁধা আর পায়ে জুতো থাকবেই থাকবে। বালি গরমে এতো তেতে থাকে যে খালি পায়ে
বেরোলে পায়ে নির্ঘাত ফোস্কা পড়বে।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে যত দূর চোখ যায়
শুধু ধু ধু বালি আর বালি।
কখনো হঠাৎ একটা ঘূর্ণী হাওয়া এসে খানিকটা
বালি গোল করে ঘুরিয়ে ওপরে তুলে দেয়। তারপর আবার সব চুপচাপ। দু সেকেন্ড আগেও যে এখানে তান্ডব হয়ে
গেছে তার চিহ্ন মাত্র নেই। যাদের জন্ম কর্ম কলকাতায়, তারা প্রকৃতির এই রুদ্র রূপ কল্পনাও করতে
পারবেনা।
রোগীরা হাসপাতালে আসে উটের গাড়ি করে। এত গরম ঘোড়াও সহ্য করতে পারেনা। কখনো কখনো জোর বালির ঝড় ওঠে - আঁধি । গরম হাওয়া বা “লু” লেগে হিট স্ট্রোকে লোক মরে। রোগী আসতে না পারলে তখন ডাক্তারকে ওরা
ঐ রকম উটের গাড়ি করে নিয়ে যায়। সোমনাথের ফর্সা রঙ এখন রোদে পুড়ে বেশ
তামাটে।
কিষণলাল কেডিয়া বলে দিয়েছেন, সবাই কিছু গরীব মানুষ নয়, বিনা পয়সায় চিকিৎসা হচ্ছে, যদি নিজে থেকে কেউ কিছু দিতে চায় নিশ্চয়
নেবেন।
সেই পাওনাটা অনেক সময় অযাচিত ভাবে আসে, রোগী সেরে ওঠার পর। কখনো আসে মুর্গী, কখনো এক ঝুড়ি আম, মোষের দুধ থেকে তৈরী ঘি - বা এক বস্তা গমের আটা। যার যেমন ক্ষমতা। একবার এসেছিল কাঁচা লঙ্কা, তেঁতুল আর গুড় দিয়ে তৈরী মিষ্টি আচার। কোথা থেকে শুনেছে বাঙালীরা সবেতে মিষ্টি
দিয়ে খায়।
মাঝে মাঝে বাড়িতে এত আম এসে যায় যে সবাই
মিলে খেয়ে শেষ করা যায়না।
তখন সিমাকোরি একটা পাতলা কাপড়ে ছেঁকে
আমের রস বের করে আর তার সঙ্গে ঘন দুধ মিশিয়ে ওদের খেতে দেয়। রুটি বা পরোটার সঙ্গে। এই বস্তুটিকে ওরা বলে আমরস্। সোমনাথের শখ - রুটি নয় পরোটা - তেলে নয়, বলে এখানকার ঘি এত সস্তা - ঘি দিয়ে বানাও। আর রোজ রাত্রে শেষ পাতে খানিকটা ক্ষীর। বলে -
-
বুঝলে কাজল, চাকরির জন্যে এই অজ গাঁয়ে পড়ে আছি, একটু ভালো মন্দ না খেলে হয় কখনো ?
মাঝে একবার সোমনাথকে বিশেষ কোন ওষুধ পত্র
আনতে জয়পুর যেতে হয়েছিলো।
ফেরার সময় টিনের বাক্সে বরফ দিয়ে মাছ
নিয়ে এসেছিলো।
কতদিন পরে মাছ! কাজলের সে কী আনন্দ! ওর সেই পরম উৎসাহে কোমরে আঁচল জড়িয়ে
মাছ রান্না করা দেখে সোমনাথের মনটা মায়ায় ভরে যায়। কলকাতার বাঙালী - তার ওপর এই মেয়ের মাছ না হলে ভাত খেয়ে
পেট ভরতোনা ।
এখন কেমন মানিয়ে নিয়েছে, একদিনের জন্যেও কোন ব্যপারে অভিযোগ নেই।
সিমাকোরি রান্না ঘরে মাটির উনুনে কাঠ
জ্বেলে রুটি বানায়,
কাজল সামনে ঢাকা বারান্দায় মোড়া পেতে
বসে ওর সঙ্গে সুখ দুঃখের গল্প করে। আর কার সঙ্গেই বা কথা বলবে? মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে মার চিঠি আসে, সে চিঠি পড়ার সময় বুকের মধ্যে চিন চিন
করে আর উত্তর লিখতে গিয়ে চিঠির কাগজ চোখের জলে ভিজে যায়।
গরম কালে সূর্য ডুবতে দেরী হয় বলে দিনটা
বেজায় লম্বা মনে হয়।
আজ প্রায় এক বছর হল পরমেশ্বরী শ্বশুর
বাড়ি চলে গেছে।
পাঁচ ছটা গ্রামের পর অন্য একটা গ্রামে
তার শ্বশুর বাড়ি।
বর মিলিটারীতে সিপাই। তাই নিয়ে পরমেশ্বরীর বাপ মঙ্গলের খুব
গর্ব।
অবশ্য মেয়ের বিয়েতে সে মোটা টাকা যৌতুকও
পেয়েছে।
হ্যাঁ, ওদের জাতে মেয়ের বাবা ছেলের পরিবারের
কাছ থেকে টাকা নেয়।
মেয়ে ওদের কাছে asset. যে সংসারে যাবে তাদেরই তো সুসার। মেয়েটা বড় হাসিখুশী ছিল। সব কথায় তার হি হি করে হাসা চাই। কাজলের ওর কথাও খুব মনে পড়ে। দুপুর হলেই সে কাজলের কাছে সেলাই শেখার
নাম করে চলে আসতো আর নানা রকম মজার মজার গল্প শোনাতো।
মঙ্গলের সামান্য অক্ষর পরিচয় আছে, এছাড়া আর কারোরই লেখাপড়ার বালাই নেই, তাই চিঠি পত্রে খোঁজ খবর নেওয়ার প্রশ্নই
ওঠেনা।
তাও পরমেশ্বরীর শ্বশুর বাড়ির গ্রাম থেকে
কেউ এসেছে শুনলে মঙ্গল সব কাজ ফেলে তার কাছে দৌড়য়, মেয়ের খবর নেবার জন্যে।
পরমেশ্বরীর শ্বশুর বাড়ির গ্রাম থেকে একজন
লোক একদিন মালসিসরে এলো।
বাড়ি অব্দি আর আসতে হয়নি - মঙ্গলের সঙ্গে তার বাজারেই দেখা হয়ে গেছে। খবর খুবই খারাপ। পরমেশ্বরীর বর মারা গেছে। না, যুদ্ধে নয় - রোড অ্যাকসিডেন্টে। চোখের জল মুছতে মুছতে মঙ্গল বাড়ি এসে
সিমাকোরিকে খবরটা দিল।
জামাইএর মৃত্যু সংবাদে ওরা দুজন একটু
কান্না কাটি করলো ঠিকই কিন্তু চট করে সামলেও উঠলো।
পরদিন রান্না
করতে করতে সিমাকোরি কাজলকে জানালো -
-
ক্যয়া কঁরে মায়জী, ভাগ
মেঁ জো লিখ্যো হ্যয় সো তো হোগো ই। পরমেশ্বরীকে বাপু পরমেশ্বরীকো অ্যঠে লেকে
আ যাওয়েগো ।
ছোরি তো অব ভি জওয়ান হ্যয়।
কাজল ভাবে সত্যিই তো, বিধবা হয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকেই বা কি
হবে।
আবার অপয়া টপয়া বলে অত্যাচার না করে! মঙ্গল গেল মেয়েকে আনতে, কিন্তু শুকনো মুখ করে ফিরে এলো। ওরা মেয়েকে ছাড়েনি।
কিছুদিনের মধ্যেই পুরো ব্যপারটা বোঝা গেলো
। বিয়ের সময় ওরা তো মঙ্গলকে অনেক টাকা যৌতুক
দিয়েছে - তার কি হবে। এদিকে মঙ্গল মনে মনে ভেবে রেখেছিল পরমেশ্বরীকে
নিজের কাছে নিয়ে এসে রাখবে, তার
পর কিছু দিন গেলে আস্তে ধীরে পাত্র দেখে আবার তার বিয়ে দেবে। বলাই বাহুল্য, আবার পাত্র পক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে।
কিন্তু পরমেশ্বরীর শ্বশুর বলেছে সব টাকা
ফেরত দিয়ে তবে মেয়ে নিয়ে যাও।
সে টাকা মঙ্গলের আছে নাকি! সে মেয়েদের
জন্যে নতুন ঘাগরা করিয়েছে, রূপোর
গয়না গড়িয়েছে,
নিজের কুঁড়েঘরটি মেরামত করিয়েছে, জামাইএর স্যুট, ঘড়ি আর বাকিটা গেছে কিছু লোকজন খাওয়ানোতে। টাকা ফেরত দাও বললেই অমন ফেরত দেওয়া যায়
নাকি?
রাতের
বেলা ছোটরা ঘুমিয়ে পড়লে মঙ্গল সিমাকোরির সঙ্গে পরামর্শ করে, কিন্তু কোন পথের সন্ধান পাওয়া যায় না।
খবরাখবর করে যা জানা গেল তা হল এই যে, পরমেশ্বরীর শ্বশুর ওকে জোর জার করছে ওর
দেওরকে বিয়ে করতে।
যে দেওর নাকি ওর চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট
।
মাস খানেক পর এক ভোর রাতে পরমেশ্বরী শ্বশুর
বাড়ি থেকে হঠাৎ এসে হাজির। পালিয়ে এসেছে।
কথায়
কথায় জানা গেল,
খবর সত্যি। ওর ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছিল দেওরকে বিয়ে
করার জন্য।
সে কথা কাজলকে
বলতে গিয়েও পরমেশ্বরী হেসে অস্থির, বলে -
-
মাজী, ম্যঁয়
বলুঁ - অরে উয় তো একদম সে বচ্চো হ্যয়। মাহনে সাদী কে লিয়ে মত্ বোলো, ম্যঁয় অঠেই থারো পাস রহ যাউঁঙ্গী। থে ফিকর না করো। তো উয় সুনে কোনি ।
ওপাশ থেকে
সিমাকোরি ফোড়ন কাটে -
-
তেরো বাপ্পু নে পয়সো লিও ...
পরমেশ্বরীর
সেই খিলখিল্ হাসি।
বলে-
-
তো কল্ শাম কো ঘর মাঁ জব ম্যঁয় একেলি থি, তো উয় সুসরা মাহরো কমরোমাঁ ঘুস আয়ো অউর
জবরদস্তি করনে লগো থো।
তো ম্যঁয়নে মাজী উনহে ইতনো জোরেসে ধক্কো
মারো তো উয় একদম সে জমিন পর পটক গয়ো। একদম্ অ্যায়সে !
আবার
সেই হাসি ।
-
তো ম্যঁয়নে মাজী তব ভি জোরসে ভাগী, অউর একদমসে বাস পকড় লিও।
কাজল অবাক হয়ে পরমেশ্বরীর মুখের দিকে চেয়ে
থাকে।
এ মেয়েটির নিজস্ব জগতে চোখের জল, হা হুতাস বা ভাগ্যকে দোষারোপ করার কোন
স্থান নেই।
উনিশ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়েছে, শ্বশুর একা পেয়ে শ্লীলতাহানি করতে গেছে, এক বস্ত্রে টাকা পয়সা গয়না গাটি সব ছেড়ে
খালি হাতে পালিয়ে এসেছে,
তাও ওর মুখের হাসি কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

No comments:
Post a Comment